লাল-চা কিংবা লাল রং - Tanjib's Log

Tanjib's Log

Tanjib's Log

Recent

লাল-চা কিংবা লাল রং

Red Blood Tea
-   আজাদ সাহেব, আপনার নামের অর্থ জানেন?
-   জ্বি জনাব, বাংলা অ্যাকাডেমি প্রণীত অভিধানের ১৩৪ তম পৃষ্ঠা অনুসারে আজাদ মানে মুক্ত, স্বাধীন, নিষ্কৃতিপ্রাপ্তও বটে। চাইনিজে দুউলি, জনাব আপনি কি চাইনিজ জানেন? 
-   না জানিনা, তবে আপনি চাইলে চাইনিজ আপনার পু*কি দিয়েও বলাতে পারব।
-   সে সুযোগ পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় যান।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে থাকা আফজাল সাহেব বাজতে থাকা ফোনটি হাতে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করতে করতে সেন্ট্রিকে বললেন-
-   মালটাকে হাজতে রাখ, আমি আসছি। 
চায়ের নেশা, বড্ড কঠিন নেশা। মাঝরাতে চা খেতে হাফ কিলো রাস্তা হেঁটে বস্তির টং দোকানে এসেছিল আজাদ। বিশুর বস্তি ঘুমায়না কখনো। ভদ্র-অভদ্র হরেক রকম কারবার চলে এখানে। চোখের ইশারায় লেনদেন হয় শ থেকে হাজার টাকার। চায়ের অপেক্ষারত আজাদের উপর পুলিশ অফিসার আফজালের সুদৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়। রাত ২ টায় নিশ্চয়ই সুকাজে আসার কথা নয় এখানে, হাজতে নিয়ে দু'চার ঘা দিলে আসল উদ্দেশ্য জানা যাবে।
-   মকবুল সাহেব, এককাপ চা খাওয়াতে পারেন? আমি আবার দুধ চা খাইনা, টি-ব্যাগের চা আনবেন, সাথে একটু লবণ দিবেন। লবণ চা খেয়েছেন কখনো? আপনার জন্যও না হয় এক কাপ নিয়ে আসুন।
-   চা ক্যান, কফি লইয়া আহি! হালা ভোদাই, চা তোর পু*কি দিয়া ভরমু।
-   খারাপ হয় না, জনাব। তাহলে পশ্চাৎদেশ থেকে অনর্গল চাইনিজ বেরোবে, কি বলেন?
-   মষ্করা কর? স্যারের আগে আমিই তোরে বানানি শুরু করমু।
-   রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। আচ্ছা জনাব, পশ্চাৎদেশের প্রতি পুলিশের এত আগ্রহ কেন বলতে পারেন?
-   ডিম ঢুকাইলে পরে বুঝবেন।
হাজতে আজাদের সাথে আরো দুই ব্যাক্তি রয়েছে। যাদের সাথে আজাদের এখনো পরিচয় হয়ে ওঠেনি। একজনের বয়স ২৪-২৫ হবে। রুক্ষ চেহারা, গাল ভিতরে এমনভাবে বসে গেছে যে, নিয়মিত হার্বাল সেবন করে তা অনায়াসে বোঝা যায়। অন্যজনের বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি। এমনভাবে গুটিসুটি মেরে বসে আছে যেন, মাঘের শীতে পর্যদুস্ত। তরুণ ছেলেটি আজাদের উদ্দেশ্যে উপরোক্ত কথাটি বলল।
-   মুখ থাকতে পিছন দিয়ে কি দরকার?    
-   মিয়া ভগর ভগর কম করেন। কি কেস!
-   জানিনা ভাই, ভগ্নিপতি সাহেব জানতে পারেন। মকবুল সাহেব, আমাকে কি চার্জ দেয়া হবে জানেন কিছু?
মকবুল সাহেবের জবাব পাওয়া গেল না, তবে তার নাসিকা-গর্জন জানান দিচ্ছে যে তিনি আছেন।

ঘন্টাদুয়েক পরে, সিগারেট ফুকতে ফুকতে আফজাল সাহেব থানায় ঢুকলেন। পরিক্ষা শুরু হওয়ার মিনিট খানেক আগে সিগারেটের শেষ অর্ধেক যেভাবে টানা হয়, ঠিক সেই ভাবে সিগারেট ফুকছেন তিনি। তার চেহারায় উত্তেজনার ভাব স্পষ্ট।
-   আফজাল সাহেব, মেয়ের নাম কী রাখবেন ঠিক করেছেন?
আজাদের ডাকে আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আফজাল সাহেব কি একটা অস্ফুট শব্দ করে বসলেন।
-   আমার মনে হয় ভেনাস নামটা বেশি ভাল লাগবে কি বলেন আফজাল সাহেব? আপনার চেহারা মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর, আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই রুপের দেবী হবে!  
-   হুম। মকবুল, আজাদ সাহেবকে এখানে নিয়ে আস।
আজাদ, আফজাল সাহেবের বিপরীত চেয়ারে বসেছে। সিগারেটের ধোঁয়া তার পিপাসা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
-   তো ছোটখাটো একটা ট্রিট দেন আফজাল সাহেব, আপাতত একটা সিগারেট আর চা দিয়েই শুরু করুন।
-   মকবুল, ২ টা চা নিয়া আস।
-   ধন্যবাদ।
-   তা, আজাদ সাহেব বলুনতো আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার স্ত্রী অসুস্থ আর আমার মেয়ে হয়েছে?
-   এ আর এমন কী! শার্লক, ওয়াটসনকে বলেছিলেন, " ইউ সী, বাট ইউ ডু নট অবসার্ভ"। আমি অবসার্ভ করেছি। যেমন আপনার এবং মকবুল সাহেবের নাম জেনেছি নেমপ্লেট দেখে। ঐ যে ছেলেটা, ওর হাতে কাটা দাগ আর গাল ভাঙ্গা, দেখেই বোঝা যায় মাদক মামলায় ওকে আটক করেছে। আবার ঐ মাঝবয়সী লোকটি, দেখুন কেমন জড়সড়ভাবে বসে আছে। ঠিকমত চেহারা দেখা যাচ্ছে না, বার বার মুখ লুকাচ্ছে। মনে হয় এমন কোন অপরাধ করেছে যার জন্য এখন সে লজ্জিত। খুব সম্ভবত ধর্ষণ মামলার আসামী।
-   বাহ! বাহ! তারপর, আমার ব্যাপারটা। তারে আগে চায়ে চুমুক দিয়ে নিন।
দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর কথা আজাদ এতদিন শুনেছে। কিন্তু, আজ লাল চায়ের স্বাদ দুধ চা'য়ে মেটাতে হচ্ছে। সাথে মার্লবোরো, আজাদের পছন্দ ব্ল্যাক।
-   আপনি যখন আমার সাথে কথা বলছিলেন, আপনার নম্বরে হোম লেখা নম্বর থেকে ২টা মেসেজ আসল। আপনি মেসেজ খুলে দেখলেন না, তবে আপনার ভ্রুকুঞ্চন আমার চোখ এড়ায়নি। এরপর একই নম্বর থেকে ফোন আসলে, আপনাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়। হোম মানে বাসা নামে কেবল আপনার স্ত্রীর নম্বরই সেভ করে রাখতে পারেন। রাত আড়াইটায় নিশ্চয়ই সে শুধু শুধু আপনাকে ফোন দিবে না। আপনার বয়স বড়জোর ৩২ হবে। এ মুহূর্তে আপনার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়া অতিমাত্রায় যুক্তিযুক্ত। আপনি বাসায় গিয়ে অল্প সময়ে ফিরে আসলেন, আপনার আচরণে আনন্দ-বেদনা-হতভম্ব অবস্থার মিশ্র রুপ বিদ্যমান। আমরা মুখে যতই বলি, ছেলে-মেয়ে উভয়ই সমান, আদতে প্রথম সন্তান ছেলেসন্তানই কামনা করি। আপনার আচরণ প্রমাণ করে আপনি সে পুত্রসন্তানের দেখা পাননি। 
তাছাড়া, আজ বুধবার, মেয়ের কথা বলে সুন্দর একটা নাম দিতে পারলাম। ছেলে হলে কী দিতাম, বুধাই! হা হা হা।
-   চমৎকার আপনার অবজারভেশন, অসাধারণ আপনার ডিডাকশন। আপনি কিন্তু সহজে মানুষকে ভড়কে দিতে পারেন।
-   আপনাকেও তবে নাড়া দিতে পারলাম নাকি!
-   তা ব'টে। এবার আমি একটু ভড়কে দেবার চেষ্টা করি, কি বলেন!
-   পুলিশ নাম শুনলেই তো জনসাধারণ ভড়কে যায়।
-   আপনি তো আর সাধারণ কেউ না, মিস্টার হোমস। শুনুন, আপনি যে ছেলেটার কথা বলছেন মাদকাসক্ত বলে, ও আসলে খুনের আসামী। প্রেমিকার বিয়ের আসরে আজ প্রেমিকার বাবাকে ছুড়ি মেরেছে। ওর হাতে যে কাটা দাগগুলো দেখেছেন তা বাস্তব জগতের নেশায় বুঁদ হয়ে আঁকেনি। অলীক প্রেমের মোহে আঁচড় কেটেছে। অন্য যে আসামীর কথা বললেন রেপিস্ট হিসেবে, উনি দুর্নীতির আসামী। অফিসের লোকজনই উনাকে ঘুষসমেত ধরে থানায় ফোন দিয়েছে। উনি যদিও বলছেন সব ষড়যন্ত্র। উনার জড়সড় দু'চোখের দিকে ভালোভাবে তাকালে পানির ফোঁটা দেখতে পেতেন।
এবার আসি আমার ব্যাপারে। আইওটি এর নাম বোধকরি শুনে থাকবেন। হোম সিকিউরিটির জন্য ইন্টারনেট অফ থিংস এর ব্যবহার করছি। ট্রাডিশনাল সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করলে আমার সমস্যা হত। আমার বাসার ড্রইং রুমে দেয়ালঘড়িতে, ডাইনিং রুমে ফ্রিজে, এবং বেডরুমে টিভিতে ভয়েস ডিটেকশন সিস্টেম চালু করা রয়েছে। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে গুগল হোমের মাধ্যমে। আমার বাসায় আমি এবং আমার স্ত্রী থাকতাম। ভয়েস ডিটেকশনে আমাদের দুজনের ভয়েস সেট করা ছিল। আমি গুগল হোম সিস্টেমকে কিছুটা টুইক করে নিয়েছি। এটি সবসময় ভয়েস ডিটেক্ট করতে থাকবে। যদি দেয়ালঘড়ি ও ফ্রিজ অপরিচিত কারো ভয়েস চিহ্নিত করতে পারে, তবে আমাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেসেজ দেবে, আর টিভি ডিটেক্ট করতে পারলে দেবে কল। গুগল হোমের সে ফোন নম্বর আমার ফোনে হোম নামে সেভ করা মিস্টার হোমস।
নিজের উপর বিরক্তি চেপে রেখে আজাদ জিজ্ঞেস করল-
-   তবে, আপনি এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গিয়েছিলেন আর কেনইবা এত দ্রুত ফিরলেন?
-   এতক্ষণ এত অবসার্ভেশন পাওয়ার দেখিয়ে এতটুকু বিষয় ধরতে পারলেন না মশাই! হোম ২ বার মেসেজ দিয়ে পরে কল করল কেন! আমার বাসায় ড্রইং রুম পেরিয়ে ডাইনিং এবং তারপরে বেডরুমের অবস্থান।
বাসার এক্সট্রা চাবি আমার কাছে আছে। ওরা অতি উত্তেজনায় বোধহয় দরজার ছিটিকিনি লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। বাসায় ঢুকে দু'জনকেই পেলাম, আমার বিছানায়, উলঙ্গ অবস্থায়। মাথা কাজ করছিলনা। মাত্র দুটা গুলিতেই দু'জন কুপোকাত। রাগে-ক্ষোভে আরো কয়েকটা বুলেট নস্ট করে এলাম। ধাতস্থ হয়ে ভীত হয়ে গেলাম, দু'টো লাশ, কীভাবে সামলাবো? তার উপর একটা আমার স্ত্রীর! এরপর আচমকা আপনার কথা মনে হল। অকুল দরিয়ায় যেন আশার আলো দেখতে পেলাম।
-   মানে?
-   মানে কিছুনা। চলুন আমার বাসায়। ডাকাত কখনো একজন হয়না, ন্যুনতম ২ জন দরকার। হাজতের বাকি দুজনের নাম খাতায় উঠে গেছে, আপনার থানায় আসার কোন লিখিত দলিল নেই। "ছোটা ডাকাত" হিসেবে আপনাকে মানাবে বেশ।

আজাদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আফজাল সাহেবের বাসায়। এরপর আরো দু'টো গুলির শব্দ। আজাদের আর লাল চা খাওয়া হলো না। তার ঠোঁটের কোণায় লেগে আছে গাঢ় লাল রং, যে রং চা'য়ের থেকে অনেকখানি লাল, অনেকখানি গাঢ়।

২দিন পরে; আফজাল সাহেব চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পরছেন। পত্রিকার শেষ পাতায় লেখা রয়েছে, "শহরে চাঞ্চল্যকর ডাকাতি। পুলিশ অফিসার আফজালের বাড়িতে গত বুধবার রাতে সশস্ত্র ডাকাতদল ঢুকে অস্ত্রের মুখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। ডাকাতদল পালানোর আগে আফজালের স্ত্রী কৌশলে তাকে ফোন করে। আফজাল ঘটনা আঁচ করতে পেরে সদলবলে তার বাসা ঘেরাও করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতদল পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলে আফজালের স্ত্রী মীরা সহ দুই ডাকাত নিহত…"। পত্রিকা রেখে চোখ বুজে আফজাল সাহেব, মকবুলকে চা আনতে পাঠায়, কড়া লিকার দিয়ে দুধ চা। লবণ মিশ্রিত চায়ের প্রতি চুমুকের সাথে একটান ব্ল্যাকের সুমধুর স্বাদ আফজাল সাহেব কখনো পাবে কি!

No comments:

Post a Comment