বন্ধু আবির, আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি ইউটিউব ভিডিওর লিংক দিয়েছে, সাথে ৫টি হাসির ইমোটিকন। লিংকের নিচে ফরিদ আর নিলয় আমাকে মেনশন করে ভিডিওটি দেখতে বলেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে ভিডিওটি চালু করলাম। এক ভদ্রলোক কবিতা পাঠ করছেন, "ও'রে আবুইল্যা, আইজগো তোরে কাঁচা খামু গিইল্যা"। কবিতায় অকারণ কোন গুরুগম্ভীর ভাব নেই, অন্তর্নিহিত কোন অর্থও হয়তো নেই। খুবই সহজ-সরল ভাষায় চিরকালীন এক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে তা'তে। ওদের হাসির কারণ যে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার বর্ণনা, তা এতক্ষণে বুঝে গেছি।
পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার পরে, অন্তু ডাক দিয়ে বলল, " কি'রে মনু, ডাইলে লবণ দেছ না দ্যাবা?" আমি মনে মনে হাসি, অবজ্ঞার হাসি, হাসি। আমি জানি আমার অঞ্চলে অন্তত কেউ এরকম জিজ্ঞেস করে না। আমি ঢাকায় এসেই প্রথম এই লাইনটি শুনি। সে যাক গে, আমার এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে আমার আকিকা দেয়া নাম লাবিব হারিয়ে "মনু" কিংবা "বরিশাইল্যা" হয়ে গেছে সেই কবে! আমি কিন্তু সেটা ভালই উপভোগ করি। আমি, আমার ভাষা, আমার অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করি। এতে আমার কোন হীনমন্যতা নেই। প্রমিত বাংলার থেকে বন্ধুমহলে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার আমার পছন্দনীয়। সে জন্য কেউ "বরিশাইল্যা", কেউবা আবার "মনু" বলে সম্বোধন করে। আমি খুশি হই এই ভেবে যে, আমার প্রাণের ভাষায় কথা বলতে পারি।
অনেক বছর আগে, বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছিলাম; মামার বাসায় বেড়াতে। বড়মামা, বাড়িতে আমার চাচার ফোনে কল দিয়ে আমার কানে ধরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, "এক মাতারি কইতে আছে, এহন দেওয়া যাইবে না।" মামা, হেসে ফেললেন। বললেন, "মাতারি না, মেয়ে বল।" জীবনে আর কোনদিন "মাতারি" বলেছি কিনা মনে নেই।
উচ্চবিদ্যালয়ে, আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা একদিন হাতে দুটো বেতের বারি দিয়েছিলেন "মুই" বলার কারণে। এখন, "মুই" এর ভিন্নরূপ "মোর", "মোগো" ব্যবহার করলেও "মুই" ব্যবহার করি না বা করা হয় না। আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে "মাতারি" ও "মুই"। এরকম ধীরে ধীরে হয়তো হারিয়ে যাবে অন্যান্য শব্দগুচ্ছ। আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাবে প্রমিত বাংলার অন্তরালে, প্রমিত বাংলা হারিয়ে যাবে ইংরেজি কিংবা হিন্দির ছায়ায়। আজ আমরা ক'জন জগা-খিচুরি না পাকিয়ে শুদ্ধভাবে আঞ্চলিক বা প্রমিত বাংলা কিংবা ইংরেজি/হিন্দি বলতে পারি? তারপরও আমরা গর্ব করি ভাষা নিয়ে, ২১শে ফেব্রুয়ারি কিংবা ৮ই ফাল্গুন নিয়ে।
No comments:
Post a Comment