আসগর সাহেব বারান্দায় বসে আছেন তার প্রিয় বেলিফুল গাছটার পাশে। গাছটা তার স্ত্রী এনেছিল তা বেশ ক'বছর আগে। বেলিফুলের প্রতি রেণু বেগমের অত্যাধিক অবসেশন ছিল। মৃত্যুশয্যায় স্বামীকে বলেছিলেন, "দু'টো ফুল এনে দাও না। একটু গন্ধ নেই। কর্পুরের কড়া গন্ধ পাচ্ছি, বড্ড খারাপ লাগছে।" কর্পুরের গন্ধ আসগর সাহেব পাননি। আজরাইল আলাইহিসসালাম কর্পুর গায়ে মাখেন কিনা তা আসগর সাহেবের জানা নাই। তবে কর্পুর যে জান্নাতি জিনিস তা তিনি যানেন। বেলিফুল গাছে তখন ফুল ছিল না। টবের পাশে গন্ধহীন বাসি কিছু ফুল পরে ছিল। রেণুর বেলি ফুলের গন্ধ আর নেয়া হয়নি। কর্পুরের গন্ধই তাকে নিয়ে গেছে পরপারে।
রহমতের মা ডাক দিল, "চাচামিয়া, হাগাখানায় গরম পানি দিয়াছি। গোসল কইর্যা ন্যান।" রহমতের মা'কে হাজারবার বলেও কোন লাভ হয়নি। গোসলখানাকে সে বলে হাগাখানা। তার যুক্তি, যে গোসলখানায় ল্যাপ্টিন (ল্যাট্রিন) আছে সেটা আবার গোসলখানা হয় কীভাবে! ওটা নিঃসন্দেহে হাগাখানা। গোসলখানায় গিজার থাকলেও আসগর সাহেবের পছন্দ সনাতন গরমপানি। মরে গেলে কেউওতো আর গিজারের পানি দিয়ে গোসল করাবে না! তাই চুলার গরম পানি দিয়ে অভ্যস্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। ঢাকায় বড়ইপাতার বড্ড অভাব, না হয় গরম পানির সাথে নিশ্চয়ই তিনি বড়ইপাতা মেশাতেন।
পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে 'ঈদ মোবারক' রব। মসজিদের শহর ঢাকায় এক মসজিদের মাইকের কারণে অন্য মসজিদের কথা কিছুই শোনা যায় না। পাশের মসজিদে ঈদের জামাত ৭:৩০ না ৮:০০ টায় তা বোঝা যাচ্ছে না। আসগর সাহেবের এখন গোসল করতে ইচ্ছা করছে না। আলসেমি ভর করেছে তার উপর। ঘুমের অভাব হতে পারে আলসেমির কারণ। আজকাল তার ঘুমে বেশ সমস্যা হচ্ছে। সেহরি খাওয়ার পরে আর ঘুম হতো না ইদানিং। কোথায় যেন সে পড়েছিল সফল ব্যাক্তিরা দিনে ৩-৪ ঘন্টার বেশি ঘুমাননা। আচ্ছা এই ৩-৪ ঘন্টা কি শুধু দিনের ১২ ঘন্টার মধ্যে; যেমন ভাতঘুমের সময়। নাকি পুরো ২৪ ঘন্টায় ৩-৪ ঘন্টা। অনেকটা ডায়াবেটিস রোগীর রুটি খাওয়া গল্পের মতো প্রশ্ন, রুটি, খাওয়ার আগে খাবে নাকি পরে। আসগর সাহেব মনে মনে হাসলেন।
আজকাল মনে মনেই বেশি কথা বলেন তিনি। বড় মেয়ে রুনুর বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল। স্বামী সংসার নিয়ে দিব্যি ব্যাস্ত সে। অস্ট্রেলিয়া থেকে মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। দু'বছরের নাতনি নানা বলতে পারে না। ডাকে দা-দা-দা-দা, বড় মধুর সে স্বর। রুনুও কি একইভাবে ডাকত আসগর সাহেবের বাবাকে! আজ আর সেসব কমই মনে পরে। আলঝেইমার জেঁকে বসেছে কিনা কে জানে! ছোট ছেলেটা জার্মানি গিয়েছে পিএইচডি করতে মাস ছয় হলো। বড় মেধাবী ছেলেটাকে ইচ্ছা থাকলেও আটকে রাখতে পারেন নি তিনি। ৪ বেডের এই বাসাতে আসগর সাহেবের এখন একা বসবাস। অথচ কয়েকবছর আগেও কোলাহলপূর্ন ছিল বাসাটা। রুনু আর বেণুর ঝগড়া লেগে থাকত সারাক্ষণ। রুনু, বেণুকে ক্ষেপাত 'হাফ-লেডিস' বলে। সাধারণত ছেলেদের নাম বেণু হয় না। তাদের মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখতে গিয়ে আশফাক আলি মাতুব্বরের ডাকনাম হয়ে গেছে বেণু। দু'ভাইবোনের মারামারি এখন বড় মিস করেন আসগর সাহেব।
পাশের মসজিদে ঈদের খুৎবা শুরু হয়ে গেছে। আসগর সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে রুনু-বেণুর সাথে কথা বলতে। আগের মত একেক সালামে ১০ টাকা করে সালামি দিতে। ইচ্ছা হচ্ছে বরাবরের মত বাপ-বেটায় একসাথে জামাতে যেতে। সে উপায় আর কই। রুনু নিশ্চয়ই কাজে ব্যাস্ত আছে, ঈদের দিনে কাজের অভাব নেই। বেণুটা ঘুমাচ্ছে। দুপুরে ফোন দেয়া যেতে পারে। এমন সময় তার মনে পরল বেশ কয়েকবছর আগের কথা। এমনি করে হয়তো তাকে সেদিন 'মিস' করেছিল দুই প্রৌঢ়। তখন ঢাকাসহ সারাদেশ লকডাউনে ছিল। ভাইরাস সংক্রমণের আশংকায় বিশ্ব তখন অস্থির। আবেগকে পাত্তা না দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সেবার তিনি গ্রামে ঈদ করতে যাননি। একমাত্র পুত্রকে অন্তত ঈদের দিনে তাদের পাশে আশা করেছিলেন আসগর সাহেবের বাবা-মা। বাবা-মাকে কষ্ট দিতে চাননি তিনি, আবার এটাও চাননি যাত্রাপথে ভাইরাস বয়ে নিয়ে বাবা-মাকে আক্রান্ত করতে। তাই থেকে গিয়েছিলেন মৃত্যুপুরিতে। সেদিন তার বাবা-মাও নিশ্চয়ই চোখের পানি ফেলেছিলেন, তিনি নিজেও কি কম কষ্ট পেয়েছিলেন! বাবা-মা ছাড়া প্রথম ঈদ কাটানো কি খুব সহজ ছিল!
মসজিদে নামাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করা যায় কিনা তা জানা নাই। ময়লা-ড্রেনের ঢাকায় খোলা ময়দান আর কোথায়! পাঞ্জেগানা নামাজও যেথায় ঈদের নামাজও সেথায়। আসগর সাহেব এখনো বারান্দায় বসে আছেন। রহমতের মা চলে গেছে। সেমাই-ফিরনি আর দুপুরের খাবার রেঁধে দিয়ে গেছে। রহমতের মায়ের হাতে আসলেই রহমত আছে। তার হাতের ফিরনি যেন বেহেশত থেকে আগত। গত ঈদে বেণু টানা একসপ্তাহ এই ফিরনিই খেয়েছে। বেণুটাকে ফিরনি রাঁধা শিখাতে পারলে ভালো হত। পরদেশে আজও হয়তো স্টারবাকসেই মিষ্টির স্বাদ নেবে।
ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে। সবাই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। যাত্রাপথে ফকিরদের যে যা পারে দান করে যাচ্ছে। রাস্তার অপরপাশে গলির মুখে টং দোকানও খুলেছে। যুবকদের ভীড় লেগেছে সেখানে। একমাস পরে সকালবেলার অতৃপ্ত তৃষ্ণা মিটাচ্ছে প্রাণভরে। টং দোকানের মালকিন তার ছোট্ট মেয়েটাকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। অন্যদিন বাচ্চাটাকে দোকানে নিয়ে আসতে দেখা যায় না। আজ ঈদের দিন বলেই হয়তো বাচ্চাকে দৃষ্টিহারা করতে চায় না সে। ফকিরের দল চলে গিয়েছে নিজ বাড়িতে, ছেলে-মেয়ের মুখে দু'টো ভালো খাবার তুলে দিতে- পরম তৃপ্তিতে। রহমতের মা'ও খাবার নিয়ে গেছে ভোলাইয়া বস্তিতে। যেখানে নতুন জামা পরে অপেক্ষা করে আছে তার প্রাণ- রহমত। গিজারযুক্ত গোসলখানায়, গোসলের পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাহিরের কোলাহলেও নিস্তব্ধ হয়ে আছে আসগর সাহেবের ৪ বেডের বাসা। চোখ তার ভারী হয়ে আসছে। সে চোখে পানির আভাস, যে পানি কিছুটা গরম, কিছুটা নোনতা। আজ তিনি কাঁদবেন, মন ভরে কাঁদবেন। আচ্ছা কান্না কি কখনো মন ভরে করা যায় নাকি মন খালি করে করতে হয়! সে কথা তার জানা নাই। কিছু কথা জানা যায়না কোনদিন। কিছু কথা জানতে হয় না কোনদিন। যেমনি জানা হয়নি, আজ থেকেই কি শুরু হল আসগর সাহেবের নিঃসঙ্গ ঈদ যাপনের!
No comments:
Post a Comment