- জীবনে না ঘুমাইন্যা মানুষ দ্যাখছেন ছার?
মুখ ভর্তি পান নিয়ে কথাটি বলছিলেন সামনে বসা ব্যাক্তি। কাঁচা ভেজানো সুপাড়ির বাজে গন্ধ ঘরের এয়ার ফ্রেশনারকে ছাপিয়ে যায়। লোকটার পান খাওয়ার মধ্যে একটা শিল্প আছে। তিনি একইসাথে পান চিবুচ্ছেন এবং কথা বলছেন। অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে জিহ্বা কালো হয়ে আছে, দেখতে ঠিক আফ্রিকান ব্লাক মামবা।
- আমি ছার ৬ বছর যাবৎ ঘুমাইনা। ঘুমাইন্যার কত চেষ্টা করছি, কিন্তু ঘুম হয় না। একলগে ৫টা ঘুমের ওষুধ খাইছিলাম, তাও হয় না। অনেক ডাক্তার দ্যাখাইছি কেউ কোন রোগ খুঁইজা পায় না। সিফাত মামায় কইল আফনের লগে দ্যাহা করতে, তাই আইলাম। স্যার আমি ঘুমাইতে চাই। একটু দ্যাখতে চাই ঘুমাইতে ক্যামন লাগে।
আমি শখের লেখক, প্রতিবছর বইমেলায় ২/১ টা বই বের হয়। সিফাত আমার মামাতো ভাই। আমার খুব ভক্ত সে। বইমেলায় আমার যত বই বিক্রি হয়, আমি জানি, তার ৯০ ভাগই নামে-বেনামে ও কিনে নেয়। নইলে আমার মত এরকম শিশুতূল্য লেখকের এত বই বিক্রি হবার কথা নয়। তাও ওর আফসোস, বেস্টসেলার কখনো হতে পারিনি। ছদরুল ব্যাপারিকে সিফাত আমার কাছে পাঠিয়েছে ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার হিসেবে।
- ছদরুল সাহেব, আপনি কি জানেন বিশ্বে একটানা না ঘুমিয়ে থাকার রেকর্ড হচ্ছে মাত্র ১১ দিনের। আর আপনি কিনা অর্ধযুগের কথা বলছেন। আপনার কথা জানলে বিশ্বে একটা হইচই শুরু হয়ে যাবে।
- হইতে পারে ছার। তয়, আমি কিন্তু স্যার সত্যি সত্যি ঘুমাইতে পারি না।
- শেষ যেবার ঘুমিয়েছিলেন তার অভিজ্ঞতা বলতে পারেন?
- জ্বে ছার, পারি। ৬ বছর আগে, আমি তহন একটা গার্মেন্টসে চাকরি করি। যেদিন গার্মেন্টসটা ভাইংগা পরে, তার আগের রাইতে শ্যাষ ঘুম ঘুমাইছিলাম। ছার, কিছু মনে কইরেন না, আমারেও একটা দিবেন?
গল্পের আভাস শুনে একটা সিগারেট ধরাচ্ছিলাম, ভদ্রলোকও একটা চাইলেন। আগে স্টার সিগারেট খেতাম। সিফাত একদিন বলল, "ভাই, তুমি লেখক মানুষ। তোমার ভাব থাকবে আলাদা। বেনসন খাবা, পকেটে আকিজ বিড়ি নিয়া ঘুরলেও, তা থাকবে বেনসনের প্যাকেটে।" আমার অবশ্য আকিজ বিড়ি খাওয়া লাগে নি। সিফাত, সপ্তাহে ২/১ বার আমার বাসায় আসে। প্রতিবারই তার হাতে থাকে ২/৩ টি বেনসনের প্যাকেট। ছদরুল সাহেবের দিকে একটা শলাকা বাড়িয়ে দিলাম। উনি বললেন-
- ছার, ম্যাজিক দ্যাখবেন? দ্যাখেন ক্যামনে তারাবাতি জ্বালাই!
আমার হাত থেকে লাইটারটি নিয়ে শুধু স্পার্ক হুইলটা বেশ কয়েকবার ঘুরালেন। এরপর একটা কাগজের উপর লাইটারটা উপুর করে কয়েকবার ঝাঁকি দিলেন। দেখা গেল কাগজের উপর কালো কালো ম্যাগনেশিয়াম ফ্লিন্টের গুড়ো পরেছে। এবার তিনি সিগারেটটা জিহ্বায় আলতো করে ভিজিয়ে ম্যাগনেশিয়াম গুড়োর উপরে ঘুরিয়ে নিলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার সিগারেটের তারাবাতি দেখছি। প্রতি টানে পট পট শব্দ করে ম্যাগনেশিয়াম আলো ছড়িয়ে তারাবাতির মতো জ্বলছে নিভছে।
- ছার, এই ম্যাজিক শিখছিলাম গাঞ্জা খাইতে গিয়া। আমারতো ঘুম হয় না, এই লাইগ্যা এক রাইতে রাস্তায় হাঁটতেছিলাম। তহন এক পুলিশে কি মনে কইর্যা থানায় লইয়া গ্যালো। ঐ রাইতে কয়েদখানায় বইয়া আইজুদ্দিন আমারে গাঞ্জা খাইতে গিয়া এইডা শিখাইছে। একটা কথা জানেন ছার, গারদে কিন্তু ১৪ শিক না, আমি ১৮ডা পর্যন্ত গুনছিলাম।
- ছদরুল সাহেব, আপনার ঘুমের গল্পটা বলুন।
- ছরি ছার, কইতাছি। আমরা, মানে আমি আর বকুল সাভারে একটা বস্তিতে থাকতাম। ঐ রাইতে আমার শ্যাষ ঘুম আছিলো। রাইত ১০টায় দুইজনে কাম থেইক্যা ফিইর্যা খাইয়া-দাইয়া শুইছি। গল্প-গুজব কইর্যা ঘুমাইছি কহন জানিনা। স্বপ্নে দেহি, আমার বকুল সাদা ল্যাহেঙ্গা পইর্যা রানি সাইজ্যা বাগানে বইয়া আছে। আমারে কয়, "লও মানিক, কুক-পলান্তিস খেলি।" স্বপ্নের মধ্যে সে পলাইছে, আর আমি খুঁজতাছি। এমন সময় বকুলের ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে ওই ছিল আমার শ্যাষ ঘুম। মনে মনে ভাবলাম বকুলরে স্বপ্নের মত একটা সাদা ল্যাহেঙ্গা কিইন্যা দিমু। সকালে দুইজনে কামে একলগে গ্যালাম। আমি কাম করি ৭ তলায় আর বকুল ৫ তলায়। কাম করার মধ্যে ৯ টার দিকে হঠাৎ কইর্যা বিল্ডিং ভাইঙ্গা পরল। আমার কি হইল কইতে পারি না। চোখ মেইল্যা দেহি আমি হাসপাতালে। মাথা ফাটছে শুধু, মাথায় ব্যান্ডেজ করা। আমার ধীরে ধীরে মনে পরল আচানক দূর্ঘটনার কথা। আমি ডাক্তাররে বকুলের কথা জিগাইলাম, সে কিছু কইতে পারল না। আমি হাসপাতাল ছাইর্যা দৌড়াইয়া গার্মেন্টসের দিকে গেলাম। গিয়া দেহি, শত শত মানুষ। গার্মেন্টস আর গার্মেন্টস নাই, ইট-পাথরের ভাগাড়। আমি সবাইরে জিগাইলাম বকুলের কথা, কেউ তার খোঁজ দিতে পারল না। হাসপাতাল খুঁজলাম, বাসায় খুঁজলাম, ইট-পাথরের মধ্যে খুঁজলাম কিন্তু বকুলরে পাইলাম না। ও যে কই পলাইছে আমি জানিনা; শুধু খুইজ্যা বেড়াই। প্রতিদিন যাইতাম গার্মেন্টসের জায়গায়, যদি বকুলরে পাওয়া যায়। মানুষ পঁচা গন্ধ পাইছেন কোনদিন ছার! আমি পাইছি ছার, এহনো পাই। আমি ঘুমাইতে গ্যালে আরো বেশি পাই, তহন আর ঘুমাইতে পারি না। এই ৬ বছরে আর কোনদিন ঘুমাইতে পারি নাই, বকুলরেও খুইজ্যা পাই নাই। আমি ছার বকুলরে পাইতে চাই, শান্তির একটা ঘুম দিতে চাই।
- আপনার ঘটনা অনেক বেদনার। আপনি একজন মানসিক রোগের ডাক্তার দেখান। তিনি আপনার রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন।
- তাও বাদ দেইনায় ছার, কিন্তু ফলাফল শুন্যই।
- তাহলে তো ভাববার বিষয়।
- জ্বে ছার, ভাবতে থাহেন। আমার হাঁটার সময় হইছে। আমি অহন যাই। আমারে একটা সিগারেট দিবেন! টানতে টানতে যাই। একটা না, দুইডা দ্যান। আইজুদ্দিনের লইগ্যা একটা লইয়া যাই।
ছদরুল ব্যাপারি ঐদিনের জন্য চলে গেলেন। আমি ভাবছি, লোকটা ঢপ মারল কিনা! আবার এমনও হতে পারে যে, মাথার আঘাতে এবং মানসিক শকে "ভেন্ট্রোল্যাটারাল প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস" জোনে অ্যানোমালির জন্য নির্ঘুমতার সৃষ্টি হয়েছে। যাই হোক না কেন, উনাকে আবার আনতে হবে। ক্যামেরার সামনে পরিক্ষা নিতে হবে আসলেই উনি না ঘুমিয়ে থাকতে পারেন কিনা।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে ছদরুল সাহেবের দেখা পাচ্ছি না। সিফাত খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে, উনি নাকি আমার সাথে শীঘ্রই দেখা করবেন। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, গলির মুখে ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। উঁকি দিয়ে দেখি, একটা লাশ পরে আছে, বীভৎস। চেহারা চেনা যাচ্ছে না। লাশটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জানতে পারলাম, রাতে ডাকাতির পায়তারা করার সময় লোকজন ধরে গণপিটুনি দিয়ে মেরেছে তাকে। আমি বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম, মানুষ কতটা নৃশংস! উপযুক্ত পরিবেশে মা'মনির ভদ্র ছেলেটাও মানুষ মারতে উল্লাসিত না হয়ে পারে না।
সে রাতে ছদরুল সাহেব এলেন। এবার উনি একা আসেন নি। সাথে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন, যার পরনে সাদা লেহেঙ্গা।
- ছার, বকুলরে আইজ খুইজ্যা পাইছি। অরেও নিয়া আইলাম আফনের কাছে। বকুল, ছাররে সালাম দেও। ছার, কালকে রাইতে হাঁটতেছিলাম। তহন আফনের কথা মনে হইল। আফনের বাসার দিকে আইতেছিলাম। দেহি পিছন থেইক্যা কিছু মানুষ ধর ধর কইর্যা দৌড়াইয়া আইয়া আমারে বেদম পিডান শুরু করছে। আমি এত জিগাই আমি কি করছি, তার কোন জবাব নাই। খালি মাইর আর মাইর। কহন হুঁশ গ্যাছেগা কইতে পারুম না। হুঁশ হইতে দেহি আমি ড্রেনের পাশে পইর্যা আছি। উডলাম, ওমা! দেহি কি আমিই আবার শুইয়া আছি ড্রেনের পাশে। ব্যাপক ভয় পাইলাম। ভয়ে এদিক দৌড়াই সেদিক দৌড়াই, আসলে দৌড়াই না, উড়ি। পরে বুঝলাম, আমি মনে হয় স্বপ্ন দ্যাখতাছি, মানে শ্যাষ পর্যন্ত আমি ঘুমাইতে পারছি। তহন আবার স্বপ্নে খুঁজতে থাকলাম বকুলরে। বকুলরে এবার পাইয়া গ্যালাম। আগে যেইহানে গার্মেন্টস ছিল, ঐহানে ডোবার পাশে বইয়া কানতেছিল।
- বলেন কী! তাহলে আজকে যে লাশটা দেখলাম, সেটা
- হয় ছার, সেইটা আমারই লাশ। এহন বুঝি আমি স্বপ্ন দেহি নাই, মইর্যা গ্যাছি। আফসুস, আমার আর ঘুমাইন্যা হইল না। ছার, একটা সিগারেট দিবেন! বকুলরে একটু তারাবাতি দ্যাহাই।
কিছুক্ষণ আগে ১১দিন ২৫মিনিটের না ঘুমানোর আন্তর্জাতিক রেকর্ড সময় অতিক্রম করলাম। এখন আর আমি ঘুমাতে পারি না। প্রতিনিয়ত নাকে একটা গন্ধ পাই, লাশের গন্ধ, নাকি কাঁচা ভেজা সুপাড়ির গন্ধ! প্রায়শই ছদরুল সাহেব আর বকুলের সাথে আমার দেখা হয়। তারা গল্প করে আমি শুনি, দেখি ছদরুল সাহেবের তারাবাতি।
একদিন খাতায় একটা ছড়া পেলাম। আমি ছড়া-কবিতা লিখতে পারিনা। তবে কি এটা ছদরুল সাহেব বা বকুল লিখেছে? কিন্তু, হাতের লেখাতো আমারই। এবার আসলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
রইব জেগে তোমার পাশে
হোক সে আঁধার কালো
ঘুমের ঘোরে খুঁজব না'কো
ঘুম হারানোই ভাল।
সবাই ঘুমোক, আত্মারা সব
ঘুম পুরিতেই যাক
মানুষ যারা তারাই শুধু
ঘুম ঝেটিয়ে নির্ঘুম থাক।
No comments:
Post a Comment