গাধা মানব - Tanjib's Log

Tanjib's Log

Tanjib's Log

Recent

গাধা মানব

Religious Fraud
১.
"গাধা একটি গৃহপালিত পশু। গাধার চারখানা হাত-পা রয়েছে। গাধা ভারবহনের কাজে ব্যবহৃত হয়। গাধা অনেক উপকারি প্রাণী। বাবা আমাকে আদর করে গাধা বলে ডাকে।"
ছোটবেলায় এরকমই ছিল আমার লেখা "প্রিয় প্রাণী"র রচনা। বাবা আমায় আদর করে গাধা ডাকতেন কিনা যানিনা, তবে আমাকে ডাকার জন্য এটাই তার প্রিয় বুলি ছিল। মিতুও মাঝে মাঝে আমাকে গাধা বলে সম্বোধন করে। গাধা জন্তুটাকে এখনো দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ভাবছি চিড়িয়াখানায় একবার ঢুঁ মেরে আসব, স্বজাতি না হলেও স্বগোত্রের সান্নিধ্য খারাপ লাগবে না বোধ করি।

পৈত্রিক সূত্রে পীরজাদা হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-কর্মে তেমন মন ছিলনা কোনদিন। বাবা ভেবেছিলেন ওয়ারিশ সূত্রে দাদার মাজারখানার দ্বায়িত্ব আমিই নিব; ভক্তের ভক্তিতে ভান্ডার পূর্ণ করব। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি হওয়ায় বাবা আরেক পুত্র সন্তানের আশায় পৃথিবীতে আনলেন আমার আরো তিন বোনকে। যাদের মধ্যে সবথেকে ছোট রাবেয়ার বয়স বছর খানেক। মাঝে মাঝে সাবের ভাইয়ার কন্যাকে আম্মু ডাকতে গিয়ে আপু ডেকে ফেলি, আবার রাবুকে আম্মু। কি এক যন্ত্রণা! তবে সব থেকে বেশি যন্ত্রণায় আমার পিতাজান। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা আরেকটা সুযোগ নিবেন সহজ আয়ের উৎসের উত্তরাধিকারের জন্যে। বাবার জন্য খারাপই লাগছে! বেচারা চিন্তায় অস্থির। সেজন্যই এখন নিজের পানি-পড়া রেখে ডঃ এজাজ সাহেবের দেয়া এনজিলক খান। সেদিন শুনলাম এক হট্টগোল লেগেছে পীর আব্বার দরবারে। কোন এক বেয়াদব মুরিদ তান্ডব চালিয়েছে। সে নাকি তার মায়ের জন্য বাবার কাছ থেকে ক্যান্সারের নিস্ফল ঔষধ পানি-পড়া নিয়ে গিয়েছিল। ২ দিন ঔষধ খাওয়ানোর মাথায় নাকি তার মা অক্কালাভ করেছে। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছে তাতে বাবার কি দোষ বুঝলাম না। বাবা শুধু ওয়াসার বিশুদ্ধ পানিতে ক্যান্সার মুক্তির দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন। এটাতো তার মায়ের ভালোর জন্যি। হয়ত মুরিদের হাদিয়া আমার মৃত পীর দাদাজানের পছন্দ হয় নাই। এজন্য তার রোশানলে পরেছে সে। বাবা বলতেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আল্লাহ বিপদ দিয়ে পরিক্ষা করেন। বাবার কাছে এই বিপদ অবশ্য কিছুই নয়। বাবার অদৃশ্য ক্ষমতার বলে সেই মুরিদের কেস পুলিশ নেয় নি। কাউন্সিলর সাহেবও বাবার ভক্ত। সেই গোলমালের সময় স্বয়ং কাউন্সিলর সাহেব এসে ঝামেলা মিটিয়ে গিয়েছেন। আমি ভাবি বাবার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার টের পায়নি ঐ মুরিদ। নইলে সে কোনদিন কোন্দলে জড়াত না। এইতো কিছুদিন আগে এক মুরিদ এসেছিলেন, তার ছোট ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার ভাই ফিরে আসবে। বাবার কি ক্ষমতা, রাত ২টার দিকে আধোঘুমে দরজা খুলে দেখি কাউন্সিলর সাহেবের ডানহাত বলে খ্যাত লিটন, ঘুমন্ত ছেলেটিকে নিয়ে এসেছে বাবার দরবারে। বাবা পরের দিন মুরিদকে বললেন জিব্রাইল আঃ গতকাল রাতে ছেলেটিকে তার দরবারে রেখে যান। আমার মনে হয় জিব্রাইল আঃ লিটনের রূপ ধরে এসে ছেলেটিকে রেখে গিয়েছে। যার সাথে স্বয়ং জিব্রাইল আঃ এর যোগাযোগ তার সাথে কেউ পাংগা নিবে বলে আমার মনে হয় না।

২.
বাবা অনেক চেস্টা করেছিলেন আমায় পীরগিরি সেখানোর। দুইদিন কিছু শেখার পর আমার মনে হয়েছিল আমি বোধ হয় বাবার মান-সম্মান রাখতে পারব না। সব রোগের মহৌষধ একটামাত্র মন্ত্র বাবা আমায় শিখিয়ে দিলেন- পানি/তেল/ডাব বা যেকোন কিছু মুখের সামনে এনে বিড়বিড় করে যা ইচ্ছা পড়ে, মাঝে মাঝে একটু উচ্চস্বরে আল্লাহ-নবীর নাম নিয়ে ফুঁ দিলেই নাকি হয়ে যাবে। আমি বুঝে ছিলাম বাবা মনে হয় আমার বৈরাগ্যপনা দেখে ভুগিজুগি বুঝিয়ে লাইনে আনতে চেয়েছিলেন। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই এর মধ্যে বাবার কোন গুপ্তবিদ্যা আছে যা তিনি এখনই তার উড়নচণ্ডী ছেলেকে শিখাতে চাননা। আমার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। বাবা প্রতি রবি এবং বৃহস্পতিবারে রোগী দেখেননা। এই দুইদিন তিনি বিশ্রামে থাকেন। কারণ শনি ও বুধবার রাতে তিনি নাকি উপরওয়ালার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ রাতদুটিতে তিনি দরবারে ব্যাস্ত থাকেন। তখন বাইরের কারো দূরের কথা ঘরের কারোরই দরবারে যাওয়ার হুকুম নেই। এমনকি ঘরের বাইরে বের হবারও অনুমতি নেই। আমি এক শনিবার রাতে গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করার উদ্দেশ্যে বাবার ঘরে আলমারিতে লুকোনো ডাইরি আনতে গেলাম। মা ঘুমে কাতর ছিলেন তাই টের পাননি। ডাইরি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন দোয়া-মন্তর পেলাম না। পেলাম কেবল কিছু হিসাব-নিকাশ। যাতে রয়েছে ভক্তদের নিকট থেকে প্রাপ্ত নগদ হাদিয়া আর অনগদ হাদিয়ার বেচা-বিক্রির হিসাব। বাবার অনেক দয়ার শরীর। তিনি প্রাপ্ত অর্থ থেকে কাউন্সিলর সাহেব - ওসি সাহেব - এমপি সাহেব সহ অনেককেই যাকাত দান করেন, যা তার ডাইরিতে হিসাববদ্ধ আছে। আশাহত হয়ে নিজের রুমে ফিরে বুঝলাম বাবার বিদ্যা তার মগজে। যেখানে প্রবেশের সাধ্য আমার নেই। তাছাড়া সারাদিন বসে বসে মানুষের সমস্যার সমাধান করার ইচ্ছাও আমার নেই। আমার ভালোলাগে ঘুরতে-ফিরতে, সিনেমা দেখতে, মাঠে খেলতে। আর সবচেয়ে বেশি ভালোলাগে মিতুকে সময় দিতে। 

৩.
মিতু আমার হৃদয়। ওকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা। মিতুর সাথে সম্পর্কের শুরুটা বাবার দরবারেই। আমি জানি স্বয়ং দাদাজানই মিতুকে আমার কাছে এনে দিয়েছেন। আমি সাধারণত দরবার চলাকালীন দরবারে যাইনা। কিন্তু একদিন মা হুঁকো হাতে আমাকে পাঠালেন দরবারে। এই সিগেরেটের আমলেও বাবা ভাব রক্ষায় হুঁকো টানেন। আমিও লুকিয়ে-ছাপিয়ে কোনদিন টানিনি তা বলবো না। আসলে সিগেরেটের নেশা মাঝরাতে গভীরভাবে পেলে দরবারে গিয়ে দুয়েক টান দেই। তো সেদিন হুঁকো দিতে গিয়ে দেখি একজন মহিলা মুরিদ তার ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে এসেছেন বাবার কাছে। মেয়েটিকে দেখে আমার বুকে যেন আগুন আগুন জ্বলে উঠল। তাই, বাবার কাছে দাঁড়িয়ে সালামের হাত থেকে পাখা নিয়ে বাবাকে বাতাস করতে লাগলাম। যদিও দরবারে ফ্যানের সুব্যাবস্থা আছে তথাপি পাখার বাতাস ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
মহিলার কাছ থেকে জানলাম মেয়েটি নাকি উল্টোপাল্টা আচরণ করে, অকারণে খিলখিল করে হাসে, একাএকা কথা বলে ইত্যাদি। মেয়ের মা চিন্তিত। মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। এ মুহুর্তে বরপক্ষের সামনে যদি এরকম আচরণ করে তবে বিয়ে তো দূরে থাক উল্টো মেয়ের 'পাগল' বদনাম হয়ে যাবে। শেষে কোনদিনও তার বিয়ের আসরে বসার সৌভাগ্য হবে না। বাবার এ সমস্যা কোন সমস্যাই না। বাবা এর থেকেও জটিল সমস্যার সমাধান করে থাকেন বলে জানি। তিনি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার বাঁ হাতের কড়ে আঙুল ধরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পরতে মেয়েটি চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলল। বাবা কিছুক্ষণ পর বললেন যে মেয়েটির উপর জ্বীনের আছর আছে। তিনি হঠাৎ ঊর্ধমুখে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন কারো কথা শুনছেন। এরপর সামনে তাকিয়ে মুরিদানকে বললেন যে মেয়েটির সাথে জ্বীনের বাদশাহর এক উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের নজর পরেছে। কাজিদের বাগানের কাছে মেয়েটিকে পেয়েছে সে। কোন একদিন চুল খোলা রেখে ভর দুপুরে ঐ বাগানের রাস্তা ধরে মেয়েটি হাঁটতেছিল, তখন জ্বীনটি তাকে পছন্দ করে ফেলে। এই জ্বীন তাড়ানো অনেক কঠিন তবে অসম্ভব নয়। বাবা ছাড়া অন্য কেউ এই জ্বীনকে বশে আনতে পারবে না। এজন্য অনেক সময় লাগবে। আমি জানি অনেক সময় মানে ভক্তের অনেক দান। এ-ও জানি বাবা হাদিয়ার অসম্মান করবেন না, জ্বীনকে তিনি বশে আনবেনই।
আমি চিন্তা করতে থাকলাম ঐ উচ্ছন্নে যাওয়া জ্বীনের সাথে বাবার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলের একটা প্রতিদ্বন্দিতা হয়ে যাক। আমি আছর করতে চাই এই মেয়ের উপর। এরপর শুরু হল সেই মেয়ের মানে মিতুর বাড়িতে আনাগোনা। পীরের ছেলে, পীরের তদবির নিয়ে যেতাম তার বাড়িতে, যদিও পীর সাহেবই অবগত ছিলেননা যে আমি তদবির নিয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে সেই আসা-যাওয়া রূপ নিল সখ্যতার আর সখ্যতা প্রেমের। মাসকয়েক পরে পীরের বদৌলতে মিতুর জ্বীনে ধরা মিলিয়ে গেল। অবশ্য আবার বিয়ের তোরজোর করলে আমার আদেশে সেই জ্বীন তান্ডব চালাত। কারণ ততদিনে মিতুর কাছ থেকে জেনেছিলাম বিয়ে না করার উদ্দেশ্যে সে নিজেই নিজের জ্বীন হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবে পাইনা বাবা কিভাবে এই পুঁচকের অভিনয় ধরতে পারেননি। নাকি ধরে ফেলেও মিতুর চাওয়াকে পূর্ণ করতে তিনিও অভিনয় করে গেছেন। বুঝিনা কিছুই, সবই উপরওয়ালার লীলাখেলা।

৪.
একদিন শনির রাতে শনি ভর করেছিল মনে হয় আমার উপর। ঘুম আসছিলনা। পীরের ছেলে হয়ে আসল নাম মুদাচ্ছির হয়ে ফেসবুক ব্যবহার করতাম না। প্রিন্স নামে আইডি ব্যবহার করি। সেদিন ফেসবুকে ৪০০ বছর আগের ক্বাবার ছবি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ক্যামেরা আবিস্কারেরও ২০০ বছর আগের ছবি মানুষ কি মহিমায় সংগ্রহ করেছে। এগুলো বোধহয় জ্বীনের কাজ, মানুষের না। কোন কামেল পীর জ্বীনের মাধ্যমে প্রিয় ক্বাবা ঘরের ছবি তুলে রেখেছিলেন যা ঐতিহাসিকগণ  জানেন না। এগুলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গেট খোলার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনি। আমি বুঝলাম কোন চোর-টোর হবে মনে হয়, কারণ শনিবার রাতে বাসায় কারো ঢোকা বা বের হওয়া নিষেধ। আমি চুপিচুপি চোর বাবাজিকে ধরব আর বুঝাব পীরের ঘরে চুরির শাস্তি এমনটা মনস্থির করলাম। লুকিয়ে বের হয়ে দেখি, বাবার কয়েকজন সাগরেদ কিছু একটা নিয়ে দরবারের দিকে ঢুকছে। অল্প আলোতে কিছু বাক্সের মত বুঝলাম। আমি জানতাম এ রাতে বাবা উপরওয়ালার সাথে কথা বলেন। আজ মনে হয় তার সাগরেদদের সাথে নিয়ে কথা বলবেন। বিষয়টা মহা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি চোরের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে রুমে ফিরলাম। পরদিন বাবার কাছে কিছু টাকা চাইতে বাবা ২টা ১০০টাকার নোট হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি লক্ষ্য করলাম ২টা নোটের একটাতে লেখা, "আল্লাহ, মিতুর সাথে আমার মিল করিয়ে দিন"। আমার স্পষ্ট মনে আছে দুইদিন আগে জুম্মার নামাজের পর মসজিদের পাশে ল্যাম্পপোস্টের সাথে লাগানো "ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজার" লেখা লাল রঙের দানবাক্সে আমিই এই নোটটি ফেলেছিলাম। আমি জানি বাবার কাছে বললে বাবা তার আধ্যাত্মিক বলে মিতুর সাথে আমার প্রেম করিয়ে দিতেন। কিন্তু, নিজের বাবার কাছে নিজের প্রেমের কথা কিভাবে বলি! তাই ঐ অলীর দরবারের বাক্সে আরজি রেখেছিলাম। আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাবা আমার মনের অবস্থা জানেন আর তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কল্যানে ঐ টাকা নিজের কাছে এনে আমাকে দেখিয়ে দিলেন যে তিনি আমার সাথে আছেন। এই ঘটনার পর বাবার কামলিয়াতি সম্পর্কে আরও উঁচু ধারণা হল। আমি বুঝতে পারলাম মিতুর সাথে আমার সম্পর্ক ঠেকানোর ক্ষমতা ঐ দুষ্ট জ্বীনেরও নেই। বাবার কুদরতে তার কিছুদিন পরেই মিতুর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়।

৫.
বাবা যে মিতুর সাথে আমার সম্পর্ক মেনে নেয়নি তা বুঝেছিলাম অনেক পরে। ততদিন পর্যন্ত জানতাম বাবা আমার সাথেই আছেন। মিতুর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তার বিয়ের জন্য ভাল পাত্র নির্বাচিত হল। বাবার কাছ থেকে মিতুর মা দোয়া নিয়ে গেলেন। আমার মনে শুরু হল জ্বালা। মিতুর জ্বীনরোগ তখন আর কোন কাজে দিল না। এত ভাল পাত্র তার বাবা-মা হাত ছাড়া করতে রাজি নয়। যেকোনো ভাবে এই পাত্রের সাথেই মিতুর বিয়ে দিবেন। আমি পরলাম মহা বিপদে। আমি জানতাম যে বাবা আমার ব্যাপারে জানেন। তাই লাজ শরমের মাথা খেয়ে বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য বাবার শরণাপন্ন হলাম। বাবা আমার কথা শুনে মহারাগন্বিত হলেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন স্কুল-কলেজে পড়া বেহায়া মেয়েকে ঘরের বউ করবেন না। তিনি আমাকে বরাবর গাধা বলে ডাকলেও সেদিন প্রথম গাধার বাচ্চা বললেন। এদিকে আমি মিতুকে ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারিনা। যাই হোকনা কেন কিছু একটা করতে হবে। সাত-পাঁচ না ভেবে পরের দিনই পালিয়ে বিয়ে করে মিতুকে নিয়ে ঘরে আসলাম। যে বাবা পরের ছেলে-বউকে বশ করার তদবির দেন, সেই বাবা নিজের ছেলেকে বশে আনতে না পেরে যারপরনাই মর্মাহত হলেন। অনেক উচ্চ্যবাচ্চ করে শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়েকে মেনে নিলেন একমাত্র পুত্র ভেবে, যে সন্তান একদিন অভিভাবক হবে তার তিন কন্যার।

৬.
আজ অনেকদিন পরে আসলাম বাপ-দাদার মাজার দরবারে; নাটক দেখতে। বাবা মারা গিয়েছেন ৩ বছর হল। মারা যাওয়ার বছর ২ আগে একদিন তিনি মুরিদদিগকে বললেন  তিনি স্বপ্নে একটি চমৎকার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি দেখেছেন যে, তিনি তার দরবারে বসে আছেন। ভক্তগণ তার চারপাশে ঘুরছে আর উচ্চারণ করছে "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাই,  লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক"। তখন হজ্জ্বের মৌসুম।  বাবা এই স্বপ্নের তরজমা করলেন, তার দরবার পবিত্র মক্কার প্রতিলিপি। এখানে একটি ক্বাবাঘরের অনুরুপ তৈরি করে এখানেই তাওয়াফ করা যাবে। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দরবারের মধ্যে দাদাজানের কবর ঘিরে ক্বাবাঘরের মত করে ছোট ঘর করে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় হল। এরপর থেকে প্রতিবছর হজ্জ্বের দিনে এখানেও তাওয়াফ শুরু হয়। যাদের হজ্জ্বের আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের জন্য বাবা সুন্দর ব্যবস্থা করে গেছেন। ২টি হজ্জ্ব আদায়ের পর বাবা মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার ৩দিন পরে শফিউদ্দিন চাচা এসে ঘোষণা করলেন যে, পীরসাহেব তাকে পীরের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে গেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন আপত্তি ছিলনা। কারণ আমি জানতাম আমি বাবার যোগ্য নই। তাছাড়া শফিউদ্দিন চাচা ছিলেন বাবার একান্ত অনুসারী। বাবা তাকে দ্বায়িত্ব দিতেই পারেন, তবে আমি বা মা কিভাবে সেকথা জানলাম না ভেবে অবাক হই।
সমস্যা শুরু হল তার কিছুদিন পরে। শফিউদ্দিন চাচা যখন আমাদেরকে বাড়ি ছাড়তে বললেন, তিনি নাকি এখানের দরবার আরো বড় করবেন। আমরা পৈত্রিকভিটা না ছাড়তে চাইলে তিনি জোর করলেন। একদিন কমিশনার সাহেবসমেত এসে জোর করে বাড়িছাড়া করলেন। কমিশনার সাহেব বললেন, পীরদের নিজের কোন সম্পত্তি থাকে না। পীরের সম্পতির উত্তরাধিকারী হয় তৎপরবর্তী পীর, এভাবে সিলসিলা চলতে থাকে। যেহেতু আমি পীর হতে পারিনি, সেহেতু বাবার সব সম্পদের মালিক এখন বর্তমান পীর শফিউদ্দিন চাচা। বাড়ি থেকে সামান্য কিছু টাকা পয়সা নিয়ে বের হতে পেরেছিলাম। আমার যে পরিবার কোনদিন অর্থকষ্টে পড়েনি, আজ তাদের বেহাল অবস্থা। ভবঘুরে এই আমি আজ পরিবারের উপার্জনক্ষম অভিভাবক। এখন আমি চিড়িয়াখানায় গাধার পিঠে মানুষ চড়িয়ে খাই। গাধা দর্শনের সাধ আমার আজ মিটেছে। এখন এই গাধাই আমার নিত্যসঙ্গী। বাবা অতি কামেল লোক ছিলেন। আজ বুঝি তিনি আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েই আমাকে অধিকাংশ সময় গাধা বলে ডাকতেন। অভাবে ভালবাসা পালিয়ে গিয়েছে। মিতু আজ সুখে আছে অন্য কারো বুকে। বাবা এজন্যেই আমার আর মিতুর সম্পর্ক মেনে নিতে চাননি।
আজ রবিবার, খবর পেলাম শফিউদ্দিন চাচা মারা গিয়েছে এই দরবারেই। কাউকে বলতে শুনেছি শনিবার গভীর রাতে কয়েকজনের গোলমাল শোনা গিয়েছিল দরবারের মধ্যে, আর সকালবেলা কেউ একজন শফিউদ্দিন চাচাকে মৃত অবস্থায় পরে থাকতে দেখে তার আসনে। ওসি সাহেব এসেছিলেন, তিনি লিখে নিয়ে গেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু। আজ আবার হজ্জ্বের দিন, আমার ধর্মে মন নেই। তবুও এলাম দেখতে, ভবিষ্যৎ পীরসাহেবের মুখখানা। দেখতে অবিরাম চলে যাওয়া পীরের আস্তানা। দেখতে এলাম বাবার দরবার।

No comments:

Post a Comment