জ্বরের ঘোরে কার যেন ডাক শুনতে পেলাম। একটু মনযোগ দিতেই বুঝলাম, ওটা আক্রান্তবাবু নয়, কান্ত বাবু। আমি কমলাকান্ত। ঠিকই ধরেছেন ঐ বঙ্কিমবাবুর বন্ধুপ্রবর। বঙ্কিমবাবু আমার লেখা ছাপিয়েছেন শুনে ফিরে এসেছিলাম। না, রয়্যালটিতে ভাগ বসাতে না, ওগুলো নেতাদের কাজ, এসেছিলাম তাকে ধন্যবাদ দিতে। তারপর থেকে এখানেই পরে রইলাম। বাবু চলে যাবার পরে তার ছেলেপুলেরাই আমায় দেখত। এখন আর তেমন কেউ আসেনা। মাঝেমধ্যে তার ছোট নাতিটা দেখে যায়। কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে চলে যায়। সেদিন আফিম আনবার জন্য দু'টি টাকা বেশি চাইতেই বলল-
- আগে তোমার বইয়ের কাটতি ছিল তাই টাকা দিতে পারতাম। এখন যা দেই তাইই অনেক বেশি। পাঠকেরা এখন বই কেনার চাইতে অনলাইন লিংক খোঁজে বেশি।
তাছাড়া দেশের অবস্থাও নাকি খারাপ। কিছু বদ-ই লোকেরাও নাকি বাবা-কাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কি দিনকাল আসল রে! অথচ খাঁটি হার্বালের জোরেই আজো টিকে আছি। আজকে একটু কম চরিয়েছিলাম, একটু জ্বর বোধ করছিলাম তাই। পাড়ার ফার্মেসির ছোকড়াটা জ্বর নিরাময়ের বটিকা দিয়েছে, এ মহল্লায় ও-ই মস্ত ডাক্তার! এমতবস্থায় হার্বালে নাকি ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
- কান্তবাবু কি ঘুমিয়েছেন!
এখন শ্যামাচরণ হয়ে যাচ্ছে স্যাম, ভগবতী হচ্ছে নীলপরী, তখন কমলাকান্তকে শুধু কান্ত বলায় দোষ কি!
জবাব দিলাম-
- কে হে ছোকড়া?
- আমি ছোকড়া বা ছুকড়ি না।
- তবে কি তৃতীয় লিংগ?
- না মশাই আমি লিংগহীন।
- মশকরা কর আমার সাথে, জানো আমি কে?
- জানব না কেন, আপনি কি জ্ঞানবান! তাছাড়া আমি থাকি আপনার ভিতরে। আমি ভাইরাস বলছি।
- তোরতো মুখই নাই কথা বল কিভাবে?
- ক্যান আমি কি কয়লা চুরি করেছি যে আমার মুখ থাকবে না।
- না মানে তোর শব্দ বের হয় কোথা থেকে?
- আজকে জ্বরের উপরে আফিম চরাইছেন তাই আমাদের বাণী শোনার ক্ষমতা ঈশ্বর আপনাকে দিয়েছেন।
- বেশ বেশ। খুব ভাল। তা, তুই কেমন আছিস?
- আমাদের ভাল কে-ই-বা চায়!
- কেন কি হয়েছে?
- কি আর হবে, আমাদের মেরে ফেলতে আপনি উঠে-পরে লেগেছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের যন্ত্রণায় জীবনযন্ত্র রাখা দায়।
- তা ঠিক তা ঠিক। তুই আমায় কষ্ট দিবি আমি তোকে মারব না!
- আপনি গতকাল একটা মাছের প্রাণ নেননি।
- তাতো আমার খাবার প্রয়োজনে, জীবন বাঁচাতে।
- আমাদেরওতো খিদে লাগে, বাচ্চা-কাচ্চার প্রয়োজন হয়। আচ্ছা বাবু কোষ বিভাজনে জন্মালে সেটা কি বাচ্চা হবে নাকি সিবলিং।
- আমি কি আর অত জানি! গুগল করতে হবে।
- হুম, জ্ঞান এখন গুগলে সীমাবদ্ধ।
- ইয়ে মানে, তুই যেন কি বলছিলি?
- বলেছিলাম, আপনার যেমন বাঁচার অধিকার আছে, আমাদেরও আছে। বাঁচার জন্য আপনি উদ্ভিদ সহ অন্যান্য জীব হত্যা করেন। এক জীবনে কত-শত কোটি জীবন হত্যা করেছেন তার হিসেব করেছেন? আর আমরা কয়েক কোটি জীবন শুধু আপনার এক জীবনে ভাগ বসিয়েছি তাতেই আমাদের মারতে চাইছেন।
- হে মূর্খ জীব, তুই জান না, মানুষ সেরা জীব। সেরা জীবনকে বাঁচাতে সবই করা যায়।
- বাবু, সেরা কিভাবে হলেন? নিজের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান যোগান দেয় অন্য জীবন। ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষাও নেন অন্য জীবের কাছ থেকে। বেঁচে থাকার অক্সিজেনও পান অন্য জীবন থেকে। আপনি যেমন পরাশ্রয়ী-পরজীবি, আমরাও তেমন। বরঞ্চ আমরা সেরা জীব। আপনারা পৃথিবীকে দুষিত করেন, আমরা জঞ্জালকে মাটিতে রুপান্তর করি।
- তুই যদি আমার থেকে শ্রেষ্ঠ হও, তবে আয় দেখি কে কাকে ঘায়েল করতে পারে।
- প্রতিটি মানবসত্ত্বায় হিংস্রতার বসবাস। উপযুক্ত পরিবেশে তা বিকশিত হয়। আমরা মানুষ নই যে, যুদ্ধ করব।
ভাইরাসের যুক্তিবোমায় হেরে গিয়ে চুপচাপ মটকা মেরে রইলাম। মস্তিষ্ককে সচল করায় নাকি ঈশ্বর ক্ষমতা নিয়ে যাওয়ায় ভাইরাসের কথা আর শুনতে পেলাম না তা জানিনা।
সকালে উঠে অতি কষ্টে সরকারি হাসপাতালে রওয়ানা দিলাম। আমার সিরিয়াল অনেক পরে, ততক্ষণ টিকব কিনা যমরাজ মালুম। পাশের এক অতীব দয়ালু ব্যাক্তি বলেছিলেন ১০০ টাকার বিনিময়ে প্রথম সিরিয়াল ধরিয়ে দিবেন। ১০০ টাকায় আমার ২ দিনের আফিমের টাকা নষ্ট হবে ভেবে ভাইটিকে নিরাশ করতে হল।
ঘন্টাদুয়েক পরে আমার ডাক পরল। বরুণদেবের কৃপায় ইতোমধ্যে দুবার আফিম খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বৈকি। হাসপাতাল যে সিগারেট-গাঁজার উপযুক্ত জায়গা তা এতদিন জানতাম না।
- নাম কি?
- শ্রী কমলাকান্ত চক্রবর্তী
- বয়স?
- ১৫০ বছর তো হবেই। আগে সঠিক দিন তারিখ বলতে পারতাম। এখন কোনটা আসল জন্ম তারিখ আর কোনটা সার্টিফিকেটের তা গুলিয়ে যাই।
- তা এখনো বেঁচে আছেন!
- জ্বি আজ্ঞে, আপনার দর্শন হয়নি তাই। মনিষ বৈদ্যের গাছ-গাছড়াতে অসুখ পালাত। যমরাজ ফিরে গেছে বারংবার।
- মনিষ বৈদ্য এত কিছু পারলে আমার কাছে কেন?
- বেঁচে নেই যে!
- আপনার মত লোককে কচ্ছপের জীবন দিতে পারলে সে মরল কিভাবে?
- অভাবে।
- এত ভাল ডাক্তার মানে বদ্যি, পসারতো থাকার কথা।
- সে রোগ সারানোই ভালো বুঝতো, ব্যবসা না। তাই ঔষধ কোম্পানিও তাকে চিনত না। তাছাড়া, বাঙালির দেশপ্রেম নাকি মুরগিতেই সীমাবদ্ধ। নামের পাশে বিদেশি ডিগ্রি না থাকলে তার পসার হবে কিভাবে! তার আবার প্রাইভেট কোচিংএ পরিচয় ছিলনা। নয়ত একটা ব্লুফিল্ড ডিগ্রি নিলেও নিতে পারত।
- বুজেছি সে কত মহান চিকিৎসক। এখন আপনার কি সমস্যা?
- আমি কি ডাক্তার?
- না, মানে কি জন্য এসেছেন?
- রোগ সারাতে।
- কি রোগ?
- সে তো আপনি বলবেন বাবু।
- আচ্ছা ঠিক আছে, এই টেস্টগুলো করে নিয়ে আসুন। এই হাসপাতালে সবগুলো পাবেন না। রাস্তার ওপারে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সেখানে সবই পাবেন। রাতে আমি ঐটাতে থাকব, তখন রিপোর্ট দেখাবেন।
- বাবু, আমার কাছে টাকা পয়সা নেই, আপনি নাড়ি-টারি দেখে রোগ বের করুন আর ঔষধ দেন। তবে এমন ঔষধ দিবেন, যাতে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া না মরে।
- এ কেমন কথা, টেস্ট ছাড়া কি অসুখ বোঝা যায়! আর ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার কারণে অসুখ হলে সেগুলো মারতেই হবে।
- না, বাবু। আমার গতরাতে বোধোদয় হয়েছে। আমার এক জীবনের জন্যে আমি কোটি প্রাণ নষ্ট করতে পারি না।
- পাগল হয়েছেন নাকি!
- তাহলে বেঁচে যেতাম, ডাক্তার দেখাতে হতো না। হত্যা আপনাদের কাজ। নইলে একজনের মিথ্যে সম্মান বাঁচানোর জন্য আরেকজনের সদ্য প্রাণ নিতে পারতেন না। আমার বাপু জাত আছে, খুনি হতে পারব না।
ডাক্তারবাবু কক্ষ থেকে বের করে দিলেন। মহাবিশ্বের সবকিছু কক্ষপথে ঘোরে। ঘোরে আমার মাথা, খুশিতে-ঠ্যালায়-চিন্তায়।
- আংকেল, আংকেল! ঘুমাচ্ছ নাকি?
- কে রে?
- আমি টাইগার।
- কোন টাইগার?
- তোমার বাসা পাহারা দেই যে, আর তুমি ভুলে গেলে!
- ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম!
- আমাকে কুত্তা বললে আংকেল!
- দুই দিনের বৈরাগি, আংকেল ফুটাও! চোরকে চোর বললে জানতাম ক্ষেপে যায়, কুত্তাও কি তাই!
- আবার কুত্তা বললে, দুঃখ পেলাম।
- দুঃখ পরে পাস। তুই ঘরে ঢুকলি কিভাবে? তুই অপবিত্র প্রাণী। ঘরটাকে দেবশুন্য করে দিলি!
- আমি মানুষের কত উপকার করি, মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু, তাও আমি অপবিত্র! তুমি বড় অকৃতজ্ঞ আংকেল। ইশ্বর তোমাদের কিভাবে ভালবাসবে!
- ছি ছি ছি! তুই অপবিত্র মুখে ইশ্বরের নাম নিলি!
- আংকেল তুমি ব্রহ্মাকে দেখেছ কখনো?
- তিনি আছেন সবার অন্তরে। তাকে দেখা যায় না।
- মানুষ তার অন্তরাত্মার সন্ধান করে না তাই তার দেখা পায় না।
- তুই এত জ্ঞানের কথা বলিস, তুই দেখেছিস বুঝি!
- দেখেছিই তো। এইতো সেদিনের কথা। আমি টুম্পাকে বাসায় ছেড়ে দিয়ে ফেরার পথে।
- কিভাবে দেখলি?
- দেখলাম কয়েকজন টুপিওয়ালা আর ধুতি পরা লোক কি নিয়ে যেন ঝগড়া করছে। হঠাৎ একজন লোক এসে তাদের থামাতে গেলে, সবাই তাকে মারতে থাকে। সে বেচারা দিল দৌড়, আমিও মারের ভয়ে দৌড়ালাম, কারণ সবকিছুর ভুক্তভোগী সাধারণরাই হয়।
- তারপর
- লোকচক্ষুর আড়াল হতে, সেই লোকটি আর আমি জিরোনার জন্য একটু বসলাম। সে বলল, “বুঝলি টাইগার,” আমিতো অবাক, আমার নাম জানল কিভাবে? “সবাই আমায় নিয়ে মারামারি করছে, কিন্তু, কেউ আমায় চিনল না। আজ মুসলিম বলে তারাই একমাত্র আল্লাহর উপাসক বাকি সবাই কাফের, কাফেরের গলা কাট। হিন্দু বলে তারাই প্রকৃত উপাসক, বাকি সব কুলীন, মার ওদের। বৌদ্ধ বলে তারাই ইশ্বরের অহিংস বার্তা, যারা তাদের বিরুদ্ধে ওদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দাও। খ্রিষ্টান বলে যিশুই সব, তার অনুসারী বাদে সবাই মিথ্যা, ধ্বংস কর বাকিদের। আমি বলি, হিন্দু না ওরা মুসলিম ওরে জিজ্ঞাসে কোনজন? ওদের পরিচয় ওরা মানুষ। আমি ইশ্বর, আমিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব, আমি আল্লাহ, আমি যিশু, যে নামেই ডাক সকল সুন্দর নাম আমারই। আমিই সবার প্রাণ দিয়েছি। আমি যেমন এশিয়ান-আফ্রিকান-আরব জাতি সৃষ্টি করেছি, তেমনি সৃষ্টি করেছি, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্ট-নাস্তিক জাতি। আমি ইশ্বরের কাছে যদি সব আস্তিকের ভিন্ন ভিন্ন ভক্তি-প্রণাম আর নাস্তিকের অবিশ্বাস সহ্য হয়, আমি যদি আমার অনুগ্রহ দিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে তোমরা কোন নচ্ছার দুনিয়ায় বিশৃঙ্খলা করার!” আমি বললাম প্রভু মানবজাতির উত্তরণের উপায় কি! মহাদেব বললেন, “এদের শুধরানোর কোন পথ নাই, অতি শিঘ্রই আমি এদের ধ্বংস করব, সাংগ করব লীলা। ততদিন এরা যাচ্ছেতাই করুক। আমি চললুম এই পৃথিবী থেকে, কিছুদিন তাদের নৈরাজ্যের অবকাশ দিলাম।” একথা বলে প্রভুদেব ঊর্ধ্বগামী হলেন।
- প্রভু তোর মত জীবকে দেখা দিলেন আর এই সেরা সৃষ্টিকে দেখা দিলেন না! ইশ্বরের বাস কি এই পল্লিতে আর হবে না!
- কিভাবে হবে আংকেল বল! একটু আগে গলির মুখের হোটেলের কসাইটা আমায় তাড়া করল। আমি কোনমতে জানে বেঁচে পালিয়ে তোমার কক্ষে ঢুকে পড়েছি।
- কেন, কি কুত্তামি করেছিলি?
- কুকুররা এখন আর কুত্তামি করে না, ওটা মানুষের কাজ। আমাকে তাড়া করেছিল জবেহ করবে বলে।
- তোকে জবাই করে কি লাভ কসাইয়ের।
- গত সপ্তাহে যে খাসির কাচ্চি খেয়েছিলে আংকেল, তা ছিল আমার টুম্পার, খাসির না।
- ছ্যা, ছ্যা কি বলিস তুই, আমার গা গুলিয়ে আসছে। তবে পত্রিকায় যে দেখলাম, দেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংস্বম্পূর্ণ।
- গরু-ছাগলগুলো কোট-টাই পরে অফিস করছে, তাই আমাদের উপর চাপ বাড়ছে। প্রাণ বাঁচানো দুস্কর আংকেল।
অন্ধকারেও যেন টাইগারের চোখের পানি দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকার আরো অন্ধকার।
No comments:
Post a Comment