ঝোড়ো হাওয়া বইছে। উঠানের পরে সুপারি গাছটা মাথা এদিক ওদিক দুলাচ্ছে; পরমানন্দে নাকি খুঁটির অভাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ঝড় মাথায় নিয়ে ঘরের দরজায় টোকা দিল আগন্তুক। প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি সুদিপ্তা। বাহিরের ভীষণ শব্দে মলিন হয়ে যায় জরুরি প্রয়োজনের ছোট শব্দ। সময়ের সাথে বাড়তে থাকে টোকার আবর্তন হার। অন্যদিন হলে দরজায় পায়ের শব্দ হলেই টের পেত কে এসেছে। আজকের দরজার শব্দটা বড় অপরিচিত ঠেকছে। সুদিপ্তা দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে বহুকাল আগের বহু পরিচিত এক মুখ। আগন্তুক ভিতরে ঢুকবার জন্য অস্থির হয়ে আছে। এই ঝড় ঝঞ্ঝার রাতে চাই একটা নিরাপদ আশ্রয়। নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিল সুদিপ্তাও। ধর্মের দোহাই দিয়ে দূরে চলে গিয়েছিল ইমরান, পাঁচ বছরের আলিঙ্গন ভুলে। এমনকি বাপ মরার পরে অসহায় সুদিপ্তার যখন প্রয়োজন শক্ত খুঁটির, তখনও দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে সুদিপ্তার অসহায় ক্রন্দন। হ্যাঁ, সুদিপ্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল একজন। গ্রামের মেম্বার সাহেব, যাকে সবাই হাজী সাহেব নামেই চেনে। তিনি দেখভাল করতেন সুদিপ্তার, খুব ভালই দেখভাল করেন তিনি। নারী মাংস তো সার্বজনীন, সেখানে ধর্মের কোন বালাই নেই। আজ এই ঝড়ের রাতে অস্পর্শ্যর আশ্রয় কি পাবে ইমরান!
Featured
দেবতার ঘুম
দেবতার ঘুম ভাঙবে যখন, শহরের পথে হাঁটব একা।
অজস্র গোলাপ ঝরছে শুধু, পথে পরছে লুটিয়ে।
বারুদের গন্ধ শুধু নয়, সিঁদুরের নদী পেরিয়ে
শহরের পথে হাঁটব একা দেবতার সন্ধানে।
মিটিং-মিছিল বদ্ধ-কামরা গোল টেবিলের পাশে
বুলি ফোটাও সাদা পায়রার, গুলি আমার ঘরে।
খুলির ভেতর শুনতে কি পাও ফাঁপা কান্নার স্বরে
ডাকছে সে মহাদেবতা-রে পথে হাঁটবে বলে।
কাঁটাতারে ক্ষত-বিক্ষত ব্যাথা, বুকের মাঝে লয়।
অগ্নিকুণ্ডে মুন্ড পাতা, শিকল পাথর-পা'য়।
পাথার-পরে বোমার ঢেউ, ব্যোমে উড়াও ছাই!
দেবতার ঘুম ভাঙবে কখন! হাঁটতে হবে একা-ই।
জাল
মশার কামড় খুব একটা খারাপ লাগছেনা এখন। মরা লাশ হলে ভালো হত, মশার কামড় দূরে থাক বাঘের কামড়ও টের পেতাম না। আচ্ছা লাশতো মরাই হয়, তবে “মরা লাশ” নিশ্চয়ই বাহুল্য দোষে দুষ্ট। মরা মানুষ বলা যেতে পারে। ইচ্ছা হলেই “মরা মনুষ্য” কাটিয়ে আলো জ্বেলে দিতে পারি। মশারি টানিয়ে সুখনিদ্রায় যেতে পারি। তাতে আমার সুখ কতটুকু হবে জানিনা, নিদ্রা সামান্যতম ও হবে না সেটা জানি। নিজের শরীরকে শাস্তি দেয়ার এই একটা ব্যবস্থা করেছি আমি। নিজের শাস্তি পাওয়াও হয় আবার স্রষ্টার বুভুক্ষু সৃষ্টির প্রয়োজনও মিটে। আলো নিভিয়ে জানালা খুলে পুরো ন্যাংটো হয়ে মশার কামড় খাওয়া হল নিজেকে প্রদত্ত আমার গুরু বা লঘু দণ্ড। নোংরা ড্রেনের সহজলভ্যতায় মশার অভাব হয়না কখনো। সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কর্মসূচি এ গলির মশাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। মশার কাছ থেকে মানবজাতির “ইম্যুনিটি স্ট্রেন্দেনের” গোপনসূত্র জানার চেষ্টা করা উচিৎ।
প্রথম কয়েকটা কামড় সুঁইয়ের মত বিঁধে। শরীরের স্বাভাবিক রিফ্লেক্স মান্য করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাত কখনো উঠে যায় নিরপরাধ মশার উপরে। নিজেকে সামলে নিতে মিনিটখানেক সময় লাগে। চেষ্টা করছি যাতে এই সময়টা শুন্যের কাছাকাছি আনা যায় কিনা।
যে যে স্থানে মশা হুল ফুটায়, মনে হয় সেসব স্থান থেকে মশা শুষে নিচ্ছে রক্তের সাথে সাথে শুয়োরের স্পর্শ। শুধু ঠোঁট স্পর্শ করতে পারে না মশাগুলো। এর কারণ অবশ্য জানা নেই। জানা থাকলে ভালো হত, ব্যবস্থা নিতাম মশার ভয় কাটানোর। একটা পরিক্ষা অবশ্য করা যায়। পলিথিনে মশা আটকে খোলা অংশ মুখে চেপে ধরা। কার্বন-ডাই-অক্সাইড মশাকে আকৃষ্ট করে জানি, কিন্তু আধিক্য হানিকর নিশ্চয়ই।
ভালবাসাও আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আসল-মেকির পার্থক্য বুঝিনি। সমদামে নকল মধুই পরিমাণে বেশি থাকে। ভালবাসা কিংবা মেকি ভালবাসার আধিক্যে এখন নিজেকে প্রতিনিয়ত সঁপে দিতে হচ্ছে শুয়োরের দেহতলে। সুকৌশলে তোলা ভিডিওতে তার অস্পষ্ট চেহারার বিপরীতে আমার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি এখন প্রতিনিয়ত আমার প্রতি পরিহাসের হাসি হাসে।
ঈদ কুরবান
আসগর সাহেব বারান্দায় বসে আছেন তার প্রিয় বেলিফুল গাছটার পাশে। গাছটা তার স্ত্রী এনেছিল তা বেশ ক'বছর আগে। বেলিফুলের প্রতি রেণু বেগমের অত্যাধিক অবসেশন ছিল। মৃত্যুশয্যায় স্বামীকে বলেছিলেন, "দু'টো ফুল এনে দাও না। একটু গন্ধ নেই। কর্পুরের কড়া গন্ধ পাচ্ছি, বড্ড খারাপ লাগছে।" কর্পুরের গন্ধ আসগর সাহেব পাননি। আজরাইল আলাইহিসসালাম কর্পুর গায়ে মাখেন কিনা তা আসগর সাহেবের জানা নাই। তবে কর্পুর যে জান্নাতি জিনিস তা তিনি যানেন। বেলিফুল গাছে তখন ফুল ছিল না। টবের পাশে গন্ধহীন বাসি কিছু ফুল পরে ছিল। রেণুর বেলি ফুলের গন্ধ আর নেয়া হয়নি। কর্পুরের গন্ধই তাকে নিয়ে গেছে পরপারে।
রহমতের মা ডাক দিল, "চাচামিয়া, হাগাখানায় গরম পানি দিয়াছি। গোসল কইর্যা ন্যান।" রহমতের মা'কে হাজারবার বলেও কোন লাভ হয়নি। গোসলখানাকে সে বলে হাগাখানা। তার যুক্তি, যে গোসলখানায় ল্যাপ্টিন (ল্যাট্রিন) আছে সেটা আবার গোসলখানা হয় কীভাবে! ওটা নিঃসন্দেহে হাগাখানা। গোসলখানায় গিজার থাকলেও আসগর সাহেবের পছন্দ সনাতন গরমপানি। মরে গেলে কেউওতো আর গিজারের পানি দিয়ে গোসল করাবে না! তাই চুলার গরম পানি দিয়ে অভ্যস্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। ঢাকায় বড়ইপাতার বড্ড অভাব, না হয় গরম পানির সাথে নিশ্চয়ই তিনি বড়ইপাতা মেশাতেন।
পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে 'ঈদ মোবারক' রব। মসজিদের শহর ঢাকায় এক মসজিদের মাইকের কারণে অন্য মসজিদের কথা কিছুই শোনা যায় না। পাশের মসজিদে ঈদের জামাত ৭:৩০ না ৮:০০ টায় তা বোঝা যাচ্ছে না। আসগর সাহেবের এখন গোসল করতে ইচ্ছা করছে না। আলসেমি ভর করেছে তার উপর। ঘুমের অভাব হতে পারে আলসেমির কারণ। আজকাল তার ঘুমে বেশ সমস্যা হচ্ছে। সেহরি খাওয়ার পরে আর ঘুম হতো না ইদানিং। কোথায় যেন সে পড়েছিল সফল ব্যাক্তিরা দিনে ৩-৪ ঘন্টার বেশি ঘুমাননা। আচ্ছা এই ৩-৪ ঘন্টা কি শুধু দিনের ১২ ঘন্টার মধ্যে; যেমন ভাতঘুমের সময়। নাকি পুরো ২৪ ঘন্টায় ৩-৪ ঘন্টা। অনেকটা ডায়াবেটিস রোগীর রুটি খাওয়া গল্পের মতো প্রশ্ন, রুটি, খাওয়ার আগে খাবে নাকি পরে। আসগর সাহেব মনে মনে হাসলেন।
আজকাল মনে মনেই বেশি কথা বলেন তিনি। বড় মেয়ে রুনুর বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল। স্বামী সংসার নিয়ে দিব্যি ব্যাস্ত সে। অস্ট্রেলিয়া থেকে মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। দু'বছরের নাতনি নানা বলতে পারে না। ডাকে দা-দা-দা-দা, বড় মধুর সে স্বর। রুনুও কি একইভাবে ডাকত আসগর সাহেবের বাবাকে! আজ আর সেসব কমই মনে পরে। আলঝেইমার জেঁকে বসেছে কিনা কে জানে! ছোট ছেলেটা জার্মানি গিয়েছে পিএইচডি করতে মাস ছয় হলো। বড় মেধাবী ছেলেটাকে ইচ্ছা থাকলেও আটকে রাখতে পারেন নি তিনি। ৪ বেডের এই বাসাতে আসগর সাহেবের এখন একা বসবাস। অথচ কয়েকবছর আগেও কোলাহলপূর্ন ছিল বাসাটা। রুনু আর বেণুর ঝগড়া লেগে থাকত সারাক্ষণ। রুনু, বেণুকে ক্ষেপাত 'হাফ-লেডিস' বলে। সাধারণত ছেলেদের নাম বেণু হয় না। তাদের মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখতে গিয়ে আশফাক আলি মাতুব্বরের ডাকনাম হয়ে গেছে বেণু। দু'ভাইবোনের মারামারি এখন বড় মিস করেন আসগর সাহেব।
পাশের মসজিদে ঈদের খুৎবা শুরু হয়ে গেছে। আসগর সাহেবের ইচ্ছা হচ্ছে রুনু-বেণুর সাথে কথা বলতে। আগের মত একেক সালামে ১০ টাকা করে সালামি দিতে। ইচ্ছা হচ্ছে বরাবরের মত বাপ-বেটায় একসাথে জামাতে যেতে। সে উপায় আর কই। রুনু নিশ্চয়ই কাজে ব্যাস্ত আছে, ঈদের দিনে কাজের অভাব নেই। বেণুটা ঘুমাচ্ছে। দুপুরে ফোন দেয়া যেতে পারে। এমন সময় তার মনে পরল বেশ কয়েকবছর আগের কথা। এমনি করে হয়তো তাকে সেদিন 'মিস' করেছিল দুই প্রৌঢ়। তখন ঢাকাসহ সারাদেশ লকডাউনে ছিল। ভাইরাস সংক্রমণের আশংকায় বিশ্ব তখন অস্থির। আবেগকে পাত্তা না দিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সেবার তিনি গ্রামে ঈদ করতে যাননি। একমাত্র পুত্রকে অন্তত ঈদের দিনে তাদের পাশে আশা করেছিলেন আসগর সাহেবের বাবা-মা। বাবা-মাকে কষ্ট দিতে চাননি তিনি, আবার এটাও চাননি যাত্রাপথে ভাইরাস বয়ে নিয়ে বাবা-মাকে আক্রান্ত করতে। তাই থেকে গিয়েছিলেন মৃত্যুপুরিতে। সেদিন তার বাবা-মাও নিশ্চয়ই চোখের পানি ফেলেছিলেন, তিনি নিজেও কি কম কষ্ট পেয়েছিলেন! বাবা-মা ছাড়া প্রথম ঈদ কাটানো কি খুব সহজ ছিল!
মসজিদে নামাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করা যায় কিনা তা জানা নাই। ময়লা-ড্রেনের ঢাকায় খোলা ময়দান আর কোথায়! পাঞ্জেগানা নামাজও যেথায় ঈদের নামাজও সেথায়। আসগর সাহেব এখনো বারান্দায় বসে আছেন। রহমতের মা চলে গেছে। সেমাই-ফিরনি আর দুপুরের খাবার রেঁধে দিয়ে গেছে। রহমতের মায়ের হাতে আসলেই রহমত আছে। তার হাতের ফিরনি যেন বেহেশত থেকে আগত। গত ঈদে বেণু টানা একসপ্তাহ এই ফিরনিই খেয়েছে। বেণুটাকে ফিরনি রাঁধা শিখাতে পারলে ভালো হত। পরদেশে আজও হয়তো স্টারবাকসেই মিষ্টির স্বাদ নেবে।
ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে। সবাই বাসায় ফিরে যাচ্ছে। যাত্রাপথে ফকিরদের যে যা পারে দান করে যাচ্ছে। রাস্তার অপরপাশে গলির মুখে টং দোকানও খুলেছে। যুবকদের ভীড় লেগেছে সেখানে। একমাস পরে সকালবেলার অতৃপ্ত তৃষ্ণা মিটাচ্ছে প্রাণভরে। টং দোকানের মালকিন তার ছোট্ট মেয়েটাকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। অন্যদিন বাচ্চাটাকে দোকানে নিয়ে আসতে দেখা যায় না। আজ ঈদের দিন বলেই হয়তো বাচ্চাকে দৃষ্টিহারা করতে চায় না সে। ফকিরের দল চলে গিয়েছে নিজ বাড়িতে, ছেলে-মেয়ের মুখে দু'টো ভালো খাবার তুলে দিতে- পরম তৃপ্তিতে। রহমতের মা'ও খাবার নিয়ে গেছে ভোলাইয়া বস্তিতে। যেখানে নতুন জামা পরে অপেক্ষা করে আছে তার প্রাণ- রহমত। গিজারযুক্ত গোসলখানায়, গোসলের পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাহিরের কোলাহলেও নিস্তব্ধ হয়ে আছে আসগর সাহেবের ৪ বেডের বাসা। চোখ তার ভারী হয়ে আসছে। সে চোখে পানির আভাস, যে পানি কিছুটা গরম, কিছুটা নোনতা। আজ তিনি কাঁদবেন, মন ভরে কাঁদবেন। আচ্ছা কান্না কি কখনো মন ভরে করা যায় নাকি মন খালি করে করতে হয়! সে কথা তার জানা নাই। কিছু কথা জানা যায়না কোনদিন। কিছু কথা জানতে হয় না কোনদিন। যেমনি জানা হয়নি, আজ থেকেই কি শুরু হল আসগর সাহেবের নিঃসঙ্গ ঈদ যাপনের!
আবুলের ঈদ আনন্দ
আবুলের মন খারাপ। পেটে ভাত নাই তার জন্য না। মন খারাপ কারণ আজ এক মাস হতে চলল সে জুতা চুরি করতে পারে নি। কি এক গযব দিয়েছেন আল্লাহপাক, মানুষজন মসজিদে যেতে পারে না। আর আবুল পারে না জুতা চুরি করতে।
আল্লাহকে আবুল ভয় করে না, তা না। আবুলের মনে হয়, 'মানুষ দুনিয়ায় আইছ খালি পায়ে, আল্লাহর কাছে নামাজেও যাবি খালি পায়ে আবার কবরেও যাবি খালি পায়ে। তাইলে তোর মসজিদের বাইরে জুতা পইর্যা ফুটানি দ্যাখান লাগবে ক্যান!' দুনিয়ার বুকে দম্ভ করে চললে নাকি কবরে শাস্তির আশংকা আছে। সেক্ষেত্রে একদিক থেকে আবুল মসজিদগামীদের শুভাকাঙ্ক্ষীই বটে। আবুলের চুরির জুতা চালান করার এক বিশ্বস্ত হকার আছে গুলিস্তানে। তার নাম মজিদ। লোকে তাকে মজিইদ্যা বলে ডাকলেও আবুল তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। প্রথম যেদিন আবুল বায়তুল মোকাররম থেকে একজোড়া বাটার নতুন জুতা সরিয়েছিল, সেদিন মজিদ তাকে চুরি করতে দেখে ফেলে। আবুলের পিছনে এসে তাকে খপ করে ধরে ফেলে। গল্পে অনেকে লেখে অতিরিক্ত ভয় পেলে নাকি শিড়দাঁড়া বেয়ে শিতল পানির স্রোত নেমে যায়, তবে আবুল টের পেল তার পেটে মোচড় দিয়ে উঠেছে। পেটের চিন্তা সারাদিন যার মাথায় ঘোরে তার পেট মোচড় দেবে এটাই স্বাভাবিক। মজিদ তাকে হাত ধরে স্টেডিয়ামের গেটে নিয়ে আসল। জিজ্ঞেস করল, এ লাইনে কতদিন। যখন বুঝল এ নতুন মাল, তখন সে আবুলকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিল। এ চত্ত্বরে সিন্ডিকেটের অভাব নেই। ছেলেপুলে যার বেশি তার আয়ও বেশি। এতক্ষণ ভয় পেলেও এক্ষণে আবুল নিশ্চিন্তে মজিদের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। আর চোরাই জুতা বিক্রির চিন্তা থেকেও মুক্তি পেল। আবুল তাকে বলল, "ভাইজান, আপনে আমার মা-বাপ। আমারে ধোলাই দিবেন না, পিঠে কিঞ্চিৎ ব্যাথা আছে। আমার জুতা আপনার হাতেই দিব। যদি না দেই তবে আপনার জুতা খাই।" মজিদ বলল, "ভাই বলবি না বাপ বলবি আগে ঠিক কর হারামজাদা। তোরে আমার দোকানে চাকরি দিলাম। তুই হবি আমার কারিগর। আমি তোর মালিক। স্যার বইল্যা ডাকলে জুতসই হইবে।" আজীবন মজিইদ্যা ডাক শুনে অভ্যস্ত মজিদ নিজেও সংশয়ে ছিল আদৌ কেউ তাকে স্যার বলবে কিনা। তাই কথার মাঝখানে স্যার উল্লেখের সময় তার গলা কিছুটা কাঁপছিল।
আবুল বাইতুল মোকাররমের বাইরে শুয়ে আছে আর ভাবছে তার সোনালী অতিতের কথা, যখন দিনে ১০-১২ জোড়া জুতা চুরির রেকর্ডও সে করেছে। এমন সময় এক সাংবাদিক গাড়ি মসজিদের সামনে এসে থামল। আবুলকে উঠিয়ে সাংবাদিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার মাস্ক কোথায়?" কি মুসিবত! আগে গ্রামে থাকতে কোন মেয়েকে "কী রে রোজা রাখস নাই ক্যান?" জিজ্ঞেস করে সে ব্যাপক পৈশাচিক আনন্দ পেত। আর ইদানিং সবাই আনন্দ পায় মুখখোলা কাউকে, "মাস্ক পরস নাই ক্যান?" জিজ্ঞেস করে। আবুল মিচকা হাসি দিয়ে বলল, "মাস্ক পইর্যা শুইছিলাম, কোন ব্যাক্কলে যেন চুরি কইর্যা নিয়া গ্যাছে ষাড়।" আবুল স্যার উচ্চারণ করতে পারে না এটা ঠিক না। ভদ্রগোছের কাউকে অপমান করার যোগ্যতা আল্লাহপাক তাকে দেয় নাই। এইজন্য কাউকে সামনা-সামনি গালি দিতে চাইলে সে ষাড় বলে সম্বোধন করে। এতে যদিও চন্দ্রবিন্দুর অভাব থাকে, তাতে ব্যাকরণ না জানা আবুলের কিছু আসে যায় না। সাংবাদিক ভদ্রলোক ক্যামেরাম্যানকে 'কাট' বলে প্রস্থান করল।
- কিরে আবুইল্যা কথা কিছু শুনছস নাকি?
- কি কথা স্যার?
- তোর কামের দিন আইয়া পরছে।
- বলেন কি স্যার!
- সারাদিন মটকা মাইরা থাকলে হইবে? দেশের খবর কিছুতো রাখস না। ঈদের দিন বায়তুল মোকাররমে জামাত হইবে ৫-৬ টা। প্রত্যেক জামাত দিয়া কম কইর্যা হইলেও ৩-৪ জোড়া ঘাই মারবি।
ঈদের জামাতের কথা শুনে আবুলের চোখ চকচক করে উঠল, দু'ফোঁটা পানিও জমলো বোধহয় চোখের কোণে। আনন্দাশ্রু বোধহয় একেই বলে। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে শেষ কবে আবুল মসজিদে গেছে তা তার মনে নেই। আজ সে যাবে, অবশ্যই যাবে। জামাত না থাকুক, বারান্দায় বসে সূরা-ক্বেরাত ছাড়াই সে দু'রাকাত নামাজ পরবে; শোকরানা নামাজ। আলস্যের দিন শেষ হয়ে এলো বলে।
আল্লাহকে আবুল ভয় করে না, তা না। আবুলের মনে হয়, 'মানুষ দুনিয়ায় আইছ খালি পায়ে, আল্লাহর কাছে নামাজেও যাবি খালি পায়ে আবার কবরেও যাবি খালি পায়ে। তাইলে তোর মসজিদের বাইরে জুতা পইর্যা ফুটানি দ্যাখান লাগবে ক্যান!' দুনিয়ার বুকে দম্ভ করে চললে নাকি কবরে শাস্তির আশংকা আছে। সেক্ষেত্রে একদিক থেকে আবুল মসজিদগামীদের শুভাকাঙ্ক্ষীই বটে। আবুলের চুরির জুতা চালান করার এক বিশ্বস্ত হকার আছে গুলিস্তানে। তার নাম মজিদ। লোকে তাকে মজিইদ্যা বলে ডাকলেও আবুল তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। প্রথম যেদিন আবুল বায়তুল মোকাররম থেকে একজোড়া বাটার নতুন জুতা সরিয়েছিল, সেদিন মজিদ তাকে চুরি করতে দেখে ফেলে। আবুলের পিছনে এসে তাকে খপ করে ধরে ফেলে। গল্পে অনেকে লেখে অতিরিক্ত ভয় পেলে নাকি শিড়দাঁড়া বেয়ে শিতল পানির স্রোত নেমে যায়, তবে আবুল টের পেল তার পেটে মোচড় দিয়ে উঠেছে। পেটের চিন্তা সারাদিন যার মাথায় ঘোরে তার পেট মোচড় দেবে এটাই স্বাভাবিক। মজিদ তাকে হাত ধরে স্টেডিয়ামের গেটে নিয়ে আসল। জিজ্ঞেস করল, এ লাইনে কতদিন। যখন বুঝল এ নতুন মাল, তখন সে আবুলকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিল। এ চত্ত্বরে সিন্ডিকেটের অভাব নেই। ছেলেপুলে যার বেশি তার আয়ও বেশি। এতক্ষণ ভয় পেলেও এক্ষণে আবুল নিশ্চিন্তে মজিদের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। আর চোরাই জুতা বিক্রির চিন্তা থেকেও মুক্তি পেল। আবুল তাকে বলল, "ভাইজান, আপনে আমার মা-বাপ। আমারে ধোলাই দিবেন না, পিঠে কিঞ্চিৎ ব্যাথা আছে। আমার জুতা আপনার হাতেই দিব। যদি না দেই তবে আপনার জুতা খাই।" মজিদ বলল, "ভাই বলবি না বাপ বলবি আগে ঠিক কর হারামজাদা। তোরে আমার দোকানে চাকরি দিলাম। তুই হবি আমার কারিগর। আমি তোর মালিক। স্যার বইল্যা ডাকলে জুতসই হইবে।" আজীবন মজিইদ্যা ডাক শুনে অভ্যস্ত মজিদ নিজেও সংশয়ে ছিল আদৌ কেউ তাকে স্যার বলবে কিনা। তাই কথার মাঝখানে স্যার উল্লেখের সময় তার গলা কিছুটা কাঁপছিল।
আবুল বাইতুল মোকাররমের বাইরে শুয়ে আছে আর ভাবছে তার সোনালী অতিতের কথা, যখন দিনে ১০-১২ জোড়া জুতা চুরির রেকর্ডও সে করেছে। এমন সময় এক সাংবাদিক গাড়ি মসজিদের সামনে এসে থামল। আবুলকে উঠিয়ে সাংবাদিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার মাস্ক কোথায়?" কি মুসিবত! আগে গ্রামে থাকতে কোন মেয়েকে "কী রে রোজা রাখস নাই ক্যান?" জিজ্ঞেস করে সে ব্যাপক পৈশাচিক আনন্দ পেত। আর ইদানিং সবাই আনন্দ পায় মুখখোলা কাউকে, "মাস্ক পরস নাই ক্যান?" জিজ্ঞেস করে। আবুল মিচকা হাসি দিয়ে বলল, "মাস্ক পইর্যা শুইছিলাম, কোন ব্যাক্কলে যেন চুরি কইর্যা নিয়া গ্যাছে ষাড়।" আবুল স্যার উচ্চারণ করতে পারে না এটা ঠিক না। ভদ্রগোছের কাউকে অপমান করার যোগ্যতা আল্লাহপাক তাকে দেয় নাই। এইজন্য কাউকে সামনা-সামনি গালি দিতে চাইলে সে ষাড় বলে সম্বোধন করে। এতে যদিও চন্দ্রবিন্দুর অভাব থাকে, তাতে ব্যাকরণ না জানা আবুলের কিছু আসে যায় না। সাংবাদিক ভদ্রলোক ক্যামেরাম্যানকে 'কাট' বলে প্রস্থান করল।
- কিরে আবুইল্যা কথা কিছু শুনছস নাকি?
- কি কথা স্যার?
- তোর কামের দিন আইয়া পরছে।
- বলেন কি স্যার!
- সারাদিন মটকা মাইরা থাকলে হইবে? দেশের খবর কিছুতো রাখস না। ঈদের দিন বায়তুল মোকাররমে জামাত হইবে ৫-৬ টা। প্রত্যেক জামাত দিয়া কম কইর্যা হইলেও ৩-৪ জোড়া ঘাই মারবি।
ঈদের জামাতের কথা শুনে আবুলের চোখ চকচক করে উঠল, দু'ফোঁটা পানিও জমলো বোধহয় চোখের কোণে। আনন্দাশ্রু বোধহয় একেই বলে। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে শেষ কবে আবুল মসজিদে গেছে তা তার মনে নেই। আজ সে যাবে, অবশ্যই যাবে। জামাত না থাকুক, বারান্দায় বসে সূরা-ক্বেরাত ছাড়াই সে দু'রাকাত নামাজ পরবে; শোকরানা নামাজ। আলস্যের দিন শেষ হয়ে এলো বলে।
বৈরাগী মন
সংসারের দামে।
মত্ত হাওয়ায় চিঠি ভাসায়েছি,
বাঁধিনি হলুদ খামে।
ফুলে ফুলে উড়িব বলে,
মৌমাছিতে ভাব।
বেড়ি পায়ে নাহি দেব,
নগ্ন পায়েই চলা স্বভাব।
পথের ধারে পথিক নহি,
অপেক্ষাতে বাঁধ।
নিশাচরী ভালবাসি তাই,
শূন্যে কাটাই রাত।
বিষাদ মনে, গহীন বনে, পাখির সনে গাই।
অসাবধানে, বাঘের পানে চোখ রাঙাতে ন'ডড়াই।
"মনু"র গল্প
বন্ধু আবির, আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি ইউটিউব ভিডিওর লিংক দিয়েছে, সাথে ৫টি হাসির ইমোটিকন। লিংকের নিচে ফরিদ আর নিলয় আমাকে মেনশন করে ভিডিওটি দেখতে বলেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে ভিডিওটি চালু করলাম। এক ভদ্রলোক কবিতা পাঠ করছেন, "ও'রে আবুইল্যা, আইজগো তোরে কাঁচা খামু গিইল্যা"। কবিতায় অকারণ কোন গুরুগম্ভীর ভাব নেই, অন্তর্নিহিত কোন অর্থও হয়তো নেই। খুবই সহজ-সরল ভাষায় চিরকালীন এক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে তা'তে। ওদের হাসির কারণ যে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার বর্ণনা, তা এতক্ষণে বুঝে গেছি।
পরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার পরে, অন্তু ডাক দিয়ে বলল, " কি'রে মনু, ডাইলে লবণ দেছ না দ্যাবা?" আমি মনে মনে হাসি, অবজ্ঞার হাসি, হাসি। আমি জানি আমার অঞ্চলে অন্তত কেউ এরকম জিজ্ঞেস করে না। আমি ঢাকায় এসেই প্রথম এই লাইনটি শুনি। সে যাক গে, আমার এসব গা-সওয়া হয়ে গেছে। ভার্সিটিতে আমার আকিকা দেয়া নাম লাবিব হারিয়ে "মনু" কিংবা "বরিশাইল্যা" হয়ে গেছে সেই কবে! আমি কিন্তু সেটা ভালই উপভোগ করি। আমি, আমার ভাষা, আমার অঞ্চলকে প্রতিনিধিত্ব করি। এতে আমার কোন হীনমন্যতা নেই। প্রমিত বাংলার থেকে বন্ধুমহলে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার আমার পছন্দনীয়। সে জন্য কেউ "বরিশাইল্যা", কেউবা আবার "মনু" বলে সম্বোধন করে। আমি খুশি হই এই ভেবে যে, আমার প্রাণের ভাষায় কথা বলতে পারি।
অনেক বছর আগে, বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছিলাম; মামার বাসায় বেড়াতে। বড়মামা, বাড়িতে আমার চাচার ফোনে কল দিয়ে আমার কানে ধরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, "এক মাতারি কইতে আছে, এহন দেওয়া যাইবে না।" মামা, হেসে ফেললেন। বললেন, "মাতারি না, মেয়ে বল।" জীবনে আর কোনদিন "মাতারি" বলেছি কিনা মনে নেই।
উচ্চবিদ্যালয়ে, আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা একদিন হাতে দুটো বেতের বারি দিয়েছিলেন "মুই" বলার কারণে। এখন, "মুই" এর ভিন্নরূপ "মোর", "মোগো" ব্যবহার করলেও "মুই" ব্যবহার করি না বা করা হয় না। আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে "মাতারি" ও "মুই"। এরকম ধীরে ধীরে হয়তো হারিয়ে যাবে অন্যান্য শব্দগুচ্ছ। আঞ্চলিক ভাষা হারিয়ে যাবে প্রমিত বাংলার অন্তরালে, প্রমিত বাংলা হারিয়ে যাবে ইংরেজি কিংবা হিন্দির ছায়ায়। আজ আমরা ক'জন জগা-খিচুরি না পাকিয়ে শুদ্ধভাবে আঞ্চলিক বা প্রমিত বাংলা কিংবা ইংরেজি/হিন্দি বলতে পারি? তারপরও আমরা গর্ব করি ভাষা নিয়ে, ২১শে ফেব্রুয়ারি কিংবা ৮ই ফাল্গুন নিয়ে।